‘সাত্তার বখশ’ বনাম ‘স্টারবাকস’: লোগো যুদ্ধ, ব্র্যান্ডিং ও আইপি'র পাঠ

ইন্টারনেট জগতে প্রায়ই কিছু ঘটনা ভাইরাল হয়, যা আমাদের হাসায়, ভাবায়, এবং গভীর কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়। ‘সাত্তার বখশ’ এবং ‘স্টারবাকস’ এর লোগো নিয়ে যে আলোচনা সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছে, তা তেমনই একটি ঘটনা। আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি মজার গল্প হলেও, ব্র্যান্ডিংয়ের দুনিয়ায় আমার অভিজ্ঞতা এবং প্রযুক্তি নিয়ে আমার আগ্রহ থেকে আমি এর মধ্যে গভীর কিছু বিষয় দেখতে পাই - বিশেষ করে বাংলাদেশের উদীয়মান ব্যবসা এবং প্রযুক্তি খাতের জন্য।
এই ভাইরাল ছবিটি শুধুমাত্র একটি কফি শপের লোগোর গল্প নয়, এটি হলো মেধাস্বত্ব এবং ব্র্যান্ড পরিচিতি নিয়ে একটি বাস্তব কেস স্টাডি। একপাশে ‘সাত্তার বখশ’-এর স্বকীয় নকশা, যা স্থানীয় সংস্কৃতির একটি মজার প্রতিফলন। অন্যপাশে বিশ্বজুড়ে পরিচিত স্টারবাকসের সাইরেন লোগো।
আইনগতভাবে এই বিতর্কের মূল বিষয় হলো ট্রেডমার্ক আইন এবং ভোক্তা বিভ্রান্তি প্রতিরোধ করা। প্রশ্ন ওঠে, একটি লোগো কি এতটাই সাদৃশ্যপূর্ণ যে তা একজন সাধারণ ভোক্তাকে বিভ্রান্ত করতে পারে? অনেক ক্ষেত্রে, যদি কোনো নকশা সুস্পষ্টভাবে অনুকরণ বা ব্যঙ্গাত্মক উদ্দেশ্যে তৈরি হয়, তবে তার আইনগত সুরক্ষা কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।
একটি লোগো শুধু একটি ছবি নয়, এটি একটি গল্পের শুরু
এখানে আপনার দেওয়া অংশটির সংক্ষিপ্ত ও অনুচ্ছেদ-শৈলীতে পুণর্লিখিত রূপ দেওয়া হলো:
একটি লোগো কেবল একটি ছবি নয়, এটি একটি গল্পের শুরু। একজন কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স এবং ব্র্যান্ডিং প্রধান হিসেবে, আমার হাতে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, আইএসপি, সফটওয়্যার ফার্ম, এমনকি টেক মিডিয়ার জন্য অনেক লোগো তৈরির অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি শিখেছি যে, লোগো তৈরি একটি সুশৃঙ্খল এবং কৌশলগত প্রক্রিয়া, কোনো হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত নয়। এটি শুরু হয় ব্র্যান্ডের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, এবং ব্যক্তিত্ব বোঝার মাধ্যমে। এরপর আমরা মার্কেট অ্যানালাইসিস করি, প্রতিযোগীদের লোগো বিশ্লেষণ করে নিজেদেরকে আলাদা করার চেষ্টা করি। এই গবেষণার ভিত্তিতে আমরা হাতে কলমে স্কেচ করি এবং সেরা ধারণাগুলো ডিজিটাল রূপ দেই। আমাদের ইন-হাউস বা বাইরের ডিজাইনারদের সাথে বসে রং ও ফন্ট নিয়ে কাজ করি, যা লোগোর ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে। এরপর আমরা ক্লায়েন্ট বা ম্যানেজমেন্টের কাছে সেরা কয়েকটি ধারণা উপস্থাপন করি। চূড়ান্ত অনুমোদনের পর, লোগোটি বিভিন্ন ফরম্যাটে ডেলিভারি দেওয়া হয় এবং একটি ব্র্যান্ড গাইডলাইন তৈরি করা হয়, যা লোগোর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি একটি ব্র্যান্ডকে শুধু একটি সুন্দর ছবি নয়, বরং একটি শক্তিশালী আইনি এবং ব্যবসায়িক ভিত্তি দেয়।
বাংলাদেশী ব্র্যান্ডগুলোর জন্য শিক্ষণীয়
‘সাত্তার বখশ’-এর ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পাই, তা হলো - দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য অন্যের নকশা অনুকরণ করা ক্ষণিকের জন্য হাইপ তৈরি করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সফলতার জন্য তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। একটি প্রচলিত কথা আছে, ধার করা পোশাকে বেশি দিন মানায় না। ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে অন্যের ডিজাইন অনুকরণ করাও তেমনি। এটি স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয়তা পেলেও, দীর্ঘমেয়াদে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে তুলনার সময়ে তা এর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের উদীয়মান স্টার্টআপ এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত:
- স্বকীয়তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া: অন্যের নকশা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া এক বিষয়, আর হুবহু অনুকরণ করা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একটি ব্র্যান্ডের নিজস্বতা থাকা অপরিহার্য।
- পেশাদারিত্বে বিনিয়োগ করা: একটি সুগঠিত ও পেশাদার ব্র্যান্ড পরিচিতি একটি প্রতিষ্ঠানের নির্ভরযোগ্যতার প্রতীক। একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লোগো তৈরি করলে তা আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং ব্র্যান্ডের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়ায়।
- দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করা: একটি ব্র্যান্ড কেবল একটি প্রতীক নয়, এটি একটি মূল্যবান সম্পদ। সাময়িক ভাইরাল হওয়া যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, একটি সফল ব্র্যান্ড হলো সেইটি যা সময়ের সাথে বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ তৈরি করে। এটি সম্ভব হয় যখন ব্র্যান্ডটি তার স্বকীয় পরিচয়ে উজ্জ্বল হয়।
পরিশেষে, প্রতিটি লোগো তৈরির পেছনে থাকে একটি গল্প, একটি স্বপ্ন এবং একটি দৃঢ় ভিত্তি। এই ভিত্তিটি যত মজবুত হবে, ব্র্যান্ডটি ততই দীর্ঘস্থায়ী হবে। মনে রাখতে হবে, কেবল দৃশ্যমান সৌন্দর্য নয়, একটি লোগোর আসল শক্তি তার বুদ্ধিবৃত্তিক মূল্যে নিহিত।