ওয়াইফাই ও পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার নিরাপদে করার কৌশল

Staff Reporter

নিজস্ব প্রতিবেদক

রবিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৫, ২২:৫৭

ওয়াইফাই ও পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার নিরাপদে করার কৌশল

ডিজিটাল যুগে ওয়াইফাই আর পাবলিক নেটওয়ার্ক আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কফি শপ থেকে শুরু করে এয়ারপোর্ট, প্রায় সব জায়গাতেই এখন ফ্রি ওয়াইফাই পাওয়া যায়। কিন্তু এই ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহার করার সময় কিছু ঝুঁকি থাকে, যা আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে পারে। তাই, ওয়াইফাই ও পাবলিক নেটওয়ার্ক নিরাপদে ব্যবহার করার কৌশল জানা আমাদের জন্য খুবই জরুরি।  

ওয়াইফাই ব্যবহারের ঝুঁকিগুলো কি কি?

পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক ব্যবহারের কিছু ঝুঁকি রয়েছে। হ্যাকাররা সহজেই আপনার ডেটা অ্যাক্সেস করতে পারে এবং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে পারে। নিচে কয়েকটি সাধারণ ঝুঁকি আলোচনা করা হলো:

  • ম্যান-ইন-দ্য-মিডল অ্যাটাক (Man-in-the-Middle Attack): হ্যাকাররা আপনার এবং ওয়েবসাইটের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে আপনার তথ্য চুরি করতে পারে।
  • স্নিফিং (Sniffing): হ্যাকাররা নেটওয়ার্কে পাঠানো ডেটা প্যাকেটগুলো ক্যাপচার করে আপনার পাসওয়ার্ড এবং অন্যান্য সংবেদনশীল তথ্য জানতে পারে।
  • ফিশিং (Phishing): হ্যাকাররা নকল ওয়াইফাই হটস্পট তৈরি করে আপনাকে সেখানে কানেক্ট করতে উৎসাহিত করতে পারে, যার মাধ্যমে তারা আপনার তথ্য চুরি করতে পারে।
  • ম্যালওয়্যার ডিস্ট্রিবিউশন (Malware Distribution): অসুরক্ষিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আপনার ডিভাইসে ম্যালওয়্যার প্রবেশ করতে পারে, যা আপনার ডেটা নষ্ট করতে পারে।

ওয়াইফাই ও পাবলিক নেটওয়ার্ক নিরাপদে ব্যবহার করার কৌশল

ওয়াইফাই ও পাবলিক নেটওয়ার্ক নিরাপদে ব্যবহার করার জন্য কিছু কৌশল অবলম্বন করা উচিত। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল আলোচনা করা হলো:

ভিপিএন (VPN) ব্যবহার করুন

ভিপিএন (Virtual Private Network) আপনার ইন্টারনেট সংযোগকে এনক্রিপ্ট করে, যার ফলে হ্যাকারদের পক্ষে আপনার ডেটা অ্যাক্সেস করা কঠিন হয়ে যায়। ভিপিএন ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি একটি সুরক্ষিত টানেলের মধ্যে দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন।

ভিপিএন কিভাবে কাজ করে?

ভিপিএন আপনার ডিভাইস এবং ইন্টারনেটের মধ্যে একটি সুরক্ষিত সংযোগ তৈরি করে। যখন আপনি ভিপিএন ব্যবহার করেন, তখন আপনার ডেটা এনক্রিপ্ট হয়ে ভিপিএন সার্ভারের মাধ্যমে যায়। এর ফলে আপনার আইপি অ্যাড্রেস (IP address) লুকানো থাকে এবং আপনার লোকেশন ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে যায়।

সেরা ভিপিএন পরিষেবা কোনটি?

বাজারে অনেক ভালো ভিপিএন পরিষেবা রয়েছে। কিছু জনপ্রিয় ভিপিএন হলো:

  • নর্ডভিপিএন (NordVPN)
  • সার্ফশার্ক (Surfshark)
  • এক্সপ্রেসভিপিএন (ExpressVPN)

সুরক্ষিত ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন

সবসময় নিশ্চিত হয়ে নিন যে আপনি যে ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করছেন, সেটি https দিয়ে শুরু হয়েছে। https মানে হলো সাইটটি Secure Sockets Layer (SSL) ব্যবহার করে আপনার ডেটা এনক্রিপ্ট করছে। ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বারে একটি তালা (lock) চিহ্ন দেখেও আপনি সাইটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন।

কিভাবে বুঝবেন ওয়েবসাইটটি সুরক্ষিত কিনা?

ওয়েবসাইটের অ্যাড্রেস বারে https এবং তালা চিহ্ন দেখে আপনি বুঝতে পারবেন সাইটটি সুরক্ষিত কিনা। এছাড়াও, আপনি SSL সার্টিফিকেট ডিটেইলস চেক করতে পারেন।

ফায়ারওয়াল (Firewall) ব্যবহার করুন

আপনার ডিভাইসে ফায়ারওয়াল চালু থাকলে এটি ক্ষতিকর প্রোগ্রাম এবং হ্যাকারদের আপনার ডিভাইসে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। ফায়ারওয়াল আপনার নেটওয়ার্ক ট্র্যাফিক নিরীক্ষণ করে এবং সন্দেহজনক কিছু দেখলে তা ব্লক করে দেয়।

ফায়ারওয়াল কিভাবে চালু করবেন?

অধিকাংশ অপারেটিং সিস্টেমে ফায়ারওয়াল বিল্টইন থাকে। আপনি সেটিংস থেকে ফায়ারওয়াল চালু করতে পারেন।

  • উইন্ডোজ (Windows): কন্ট্রোল প্যানেল > সিস্টেম এবং সিকিউরিটি > উইন্ডোজ ডিফেন্ডার ফায়ারওয়াল।
  • ম্যাকওএস (macOS): সিস্টেম প্রিফারেন্সেস > সিকিউরিটি এবং প্রাইভেসি > ফায়ারওয়াল।

পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় যা মনে রাখতে হবে

পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় কিছু অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। নিচে কয়েকটি টিপস দেওয়া হলো:

  • অপরিচিত নেটওয়ার্কে অটো-কানেক্ট অপশন বন্ধ রাখুন।
  • সংবেদনশীল তথ্য যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • আপনার ডিভাইসের সফটওয়্যার এবং অপারেটিং সিস্টেম সবসময় আপডেট রাখুন।
  • পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের পর আপনার ডিভাইসের ওয়াইফাই সংযোগ বন্ধ করে দিন।

শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন

দুর্বল পাসওয়ার্ড আপনার অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তা দুর্বল করে দেয়। তাই, সবসময় শক্তিশালী এবং জটিল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।

কিভাবে শক্তিশালী পাসওয়ার্ড তৈরি করবেন?

  • কমপক্ষে ১২টি অক্ষর ব্যবহার করুন।
  • ছোট ও বড় হাতের অক্ষর, সংখ্যা এবং বিশেষ চিহ্ন (!@#$) ব্যবহার করুন।
  • ব্যক্তিগত তথ্য যেমন নাম, জন্ম তারিখ বা ফোন নম্বর ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
  • বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।

টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (2FA) ব্যবহার করুন

টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন আপনার অ্যাকাউন্টের সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত একটি স্তর যোগ করে। যখন আপনি লগইন করেন, তখন আপনার পাসওয়ার্ডের পাশাপাশি আপনার মোবাইল ফোনে একটি কোড পাঠানো হয়, যা আপনাকে প্রবেশ করার জন্য ব্যবহার করতে হয়।

কিভাবে টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন চালু করবেন?

অধিকাংশ অনলাইন সার্ভিস যেমন গুগল (Google), ফেসবুক (Facebook) এবং টুইটার (Twitter) টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন সমর্থন করে। আপনি অ্যাকাউন্টের সেটিংস থেকে এটি চালু করতে পারেন।

নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেট করুন

সফটওয়্যার আপডেটের মাধ্যমে নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সমাধান করা হয়। তাই, আপনার ডিভাইসের অপারেটিং সিস্টেম, ব্রাউজার এবং অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশন সবসময় আপডেট রাখা উচিত।

সফটওয়্যার আপডেট কিভাবে করবেন?

অধিকাংশ ডিভাইসে অটোমেটিক আপডেটের অপশন থাকে। আপনি সেটিংস থেকে এটি চালু করতে পারেন। এছাড়াও, আপনি ম্যানুয়ালি আপডেট চেক করতে পারেন।

অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন

অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার আপনার ডিভাইসকে ম্যালওয়্যার এবং ভাইরাস থেকে রক্ষা করে। এটি আপনার ডিভাইসে নিয়মিত স্ক্যান করে ক্ষতিকর কিছু পেলে তা সরিয়ে দেয়।

সেরা অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার কোনটি?

বাজারে অনেক ভালো অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার রয়েছে। কিছু জনপ্রিয় অ্যান্টিভাইরাস হলো:

  • নর্টন (Norton)
  • ম্যাকফি (McAfee)
  • বিটডিফেন্ডার (Bitdefender)

পাবলিক কম্পিউটারে লগইন করা থেকে বিরত থাকুন

পাবলিক কম্পিউটারে আপনার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে লগইন করা উচিত না। যদি লগইন করতেই হয়, তাহলে ব্যবহারের পর অবশ্যই লগআউট করুন এবং ব্রাউজিং হিস্টরি মুছে দিন।

পাবলিক কম্পিউটারে লগইন করলে কি ঝুঁকি থাকে?

পাবলিক কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার থাকতে পারে যা আপনার তথ্য চুরি করতে পারে। এছাড়াও, আপনার লগইন তথ্য সেভ হয়ে থাকতে পারে, যা অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারে।

অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস (Apps) থেকে সাবধান থাকুন

অপ্রয়োজনীয় অ্যাপস আপনার ডিভাইসের নিরাপত্তা দুর্বল করতে পারে। তাই, শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় অ্যাপস ইনস্টল করুন এবং নিয়মিতভাবে অব্যবহৃত অ্যাপস আনইনস্টল করুন।

কিভাবে ক্ষতিকর অ্যাপস সনাক্ত করবেন?

অ্যাপস ডাউনলোড করার আগে রিভিউ এবং রেটিং চেক করুন। এছাড়াও, অ্যাপসের পারমিশনগুলো ভালোভাবে দেখে নিন। সন্দেহজনক কিছু দেখলে সেই অ্যাপস ইনস্টল করা থেকে বিরত থাকুন।

পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সুবিধা ও অসুবিধা

পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। নিচে একটি টেবিলে তা উল্লেখ করা হলো:

সুবিধা অসুবিধা
বিনামূল্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে।
যেকোনো জায়গায় সহজে কানেক্ট করা যায়। ডেটা চুরির সম্ভাবনা থাকে।
জরুরি প্রয়োজনে দ্রুত ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়। ম্যালওয়্যার আক্রমণের ঝুঁকি থাকে।
ভ্রমণকালে সুবিধাজনক। গতি কম হতে পারে।

কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর

  • পাবলিক ওয়াইফাই কি নিরাপদ?
    পাবলিক ওয়াইফাই সাধারণত নিরাপদ নয়। এখানে হ্যাকারদের দ্বারা আপনার তথ্য চুরি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
  • আমি কিভাবে বুঝবো যে আমার ওয়াইফাই হ্যাক হয়েছে?
    যদি আপনার ডিভাইসের গতি কমে যায়, অপরিচিত প্রোগ্রাম ইনস্টল করা থাকে অথবা অস্বাভাবিক অ্যাক্টিভিটি দেখতে পান, তাহলে বুঝতে হবে আপনার ওয়াইফাই হ্যাক হয়েছে।
  • ওয়াইফাই রাউটার হ্যাক হলে কি করতে হবে?
    প্রথমে আপনার রাউটারের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন এবং ফ্যাক্টরি রিসেট করুন। এরপর, রাউটারের ফার্মওয়্যার আপডেট করুন এবং শক্তিশালী নিরাপত্তা প্রোটোকল ব্যবহার করুন।
  • পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় কি ভিপিএন ব্যবহার করা জরুরি?
    হ্যাঁ, পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় ভিপিএন ব্যবহার করা জরুরি। এটি আপনার ডেটা এনক্রিপ্ট করে এবং আপনার পরিচয় গোপন রাখে।
  • ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় আমার কি করা উচিত না?
    ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় সংবেদনশীল তথ্য যেমন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দেওয়া উচিত না। এছাড়াও, ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে লগইন করা থেকে বিরত থাকুন।

পরিশেষে, ওয়াইফাই ও পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি। উপরে দেওয়া কৌশলগুলো অনুসরণ করে আপনি নিরাপদে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন এবং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত রাখতে পারেন।