সাইবার হামলা থেকে বাঁচুন : সহজ উপায় জেনে নিন

Staff Reporter

নিজস্ব প্রতিবেদক

মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট ২০২৫, ২০:১৮

সাইবার হামলা থেকে বাঁচুন : সহজ উপায় জেনে নিন

ইন্টারনেট আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এর সাথে সাথে বাড়ছে সাইবার হামলার ঝুঁকিও। আপনি কি জানেন, সামান্য অসাবধানতার কারণে আপনার মূল্যবান তথ্য চুরি হতে পারে? ভয় পাবেন না, সাইবার হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার অনেক সহজ উপায় আছে। 

সাইবার হামলা কী এবং কেন হয়?

সাইবার হামলা মানে হলো, কোনো ব্যক্তি বা দল ইন্টারনেটের মাধ্যমে আপনার কম্পিউটার, মোবাইল বা নেটওয়ার্কে অনধিকার প্রবেশ করে ডেটা চুরি করা, ক্ষতি করা অথবা সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়া।

সাইবার হামলার কারণ

  • অর্থের লোভ: হ্যাকাররা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ডের তথ্য চুরি করে টাকা হাতিয়ে নিতে চায়।
  • তথ্য চুরি: আপনার ব্যক্তিগত বা অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ডেটা চুরি করে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে।
  • প্রতিহিংসা: কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে আপনার ওয়েবসাইট বা সিস্টেমের ক্ষতি করতে পারে।
  • রাজনৈতিক উদ্দেশ্য: কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাইবার হামলা চালাতে পারে।

সাইবার হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার সহজ উপায়

সাইবার হামলা থেকে বাঁচতে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললেই যথেষ্ট। আসুন, সেই উপায়গুলো জেনে নিই:

শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন

দুর্বল পাসওয়ার্ড সাইবার হামলার প্রধান কারণ। আপনার পাসওয়ার্ড যেন অবশ্যই শক্তিশালী হয়।

  • লম্বা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন (অন্তত ১২টি অক্ষর)।
  • অক্ষর, সংখ্যা ও বিশেষ চিহ্নের মিশ্রণ ব্যবহার করুন।
  • নাম, জন্ম তারিখ বা সাধারণ শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
  • বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের জন্য আলাদা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
  • পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করে নিরাপদে পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করুন।

সফটওয়্যার আপডেট রাখুন

আপনার কম্পিউটার, মোবাইল এবং অন্যান্য ডিভাইসের সফটওয়্যার সবসময় আপডেট রাখুন।

  • অপারেটিং সিস্টেম (যেমন: উইন্ডোজ, অ্যান্ড্রয়েড) এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর লেটেস্ট ভার্সন ব্যবহার করুন।
  • নিয়মিত সফটওয়্যার আপডেটের জন্য অটো-আপডেট অপশন চালু রাখুন।
  • আপডেটগুলোতে সাধারণত নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সমাধান করা হয়, যা হ্যাকারদের জন্য আপনার ডিভাইসে প্রবেশ করা কঠিন করে তোলে।

অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন

কম্পিউটার এবং মোবাইলে ভালো মানের অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন।

  • নিয়মিত অ্যান্টিভাইরাস ডেটাবেস আপডেট করুন।
  • ফুল সিস্টেম স্ক্যান করে ক্ষতিকর প্রোগ্রামগুলো চিহ্নিত করুন এবং সরিয়ে ফেলুন।
  • ফ্রি অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহারের চেয়ে পেইড অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করা ভালো, কারণ পেইড ভার্সনে সাধারণত বেশি নিরাপত্তা ফিচার থাকে।

সন্দেহজনক লিঙ্ক এবং ইমেইল থেকে সাবধান থাকুন

অপরিচিত বা সন্দেহজনক ইমেইল এবং লিঙ্কে ক্লিক করা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলুন।

  • স্প্যাম ইমেইলগুলো এড়িয়ে চলুন এবং কোনো অ্যা attachments ডাউনলোড করবেন না।
  • অপরিচিত ওয়েবসাইট ভিজিট করা থেকে বিরত থাকুন।
  • কোনো লিঙ্কে ক্লিক করার আগে ভালোভাবে দেখে নিন, সেটি আসল ওয়েবসাইট কিনা।

ফায়ারওয়াল ব্যবহার করুন

ফায়ারওয়াল আপনার কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটের মধ্যে একটি সুরক্ষা দেয়াল তৈরি করে।

  • আপনার কম্পিউটারে ফায়ারওয়াল চালু আছে কিনা, তা নিশ্চিত করুন।
  • রাউটারে ফায়ারওয়াল সেটিংস কনফিগার করুন, যা আপনার নেটওয়ার্ককে অতিরিক্ত সুরক্ষা দেবে।

টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন ব্যবহার করুন

টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (2FA) আপনার অ্যাকাউন্টের সুরক্ষার জন্য অতিরিক্ত একটি স্তর যোগ করে।

  • যেসব ওয়েবসাইটে 2FA এর সুবিধা আছে, সেগুলোতে এটি চালু করুন।
  • 2FA চালু করলে, পাসওয়ার্ডের পাশাপাশি আপনার মোবাইল ফোনে একটি কোড পাঠানো হবে, যা লগইন করার সময় ব্যবহার করতে হবে।

পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারে সতর্কতা

পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার সময় সাবধান থাকুন।

  • পাবলিক ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে ব্যক্তিগত বা আর্থিক লেনদেন করা থেকে বিরত থাকুন।
  • ভিপিএন (VPN) ব্যবহার করে আপনার ইন্টারনেট সংযোগ সুরক্ষিত করুন।

নিয়মিত ডেটা ব্যাকআপ রাখুন

নিয়মিত আপনার গুরুত্বপূর্ণ ডেটা ব্যাকআপ রাখুন।

  • এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ বা ক্লাউড স্টোরেজে ডেটা ব্যাকআপ রাখতে পারেন।
  • যদি সাইবার হামলার শিকার হন, তাহলে ব্যাকআপ থেকে ডেটা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন

সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলুন।

  • আপনার ঠিকানা, ফোন নম্বর এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য পাবলিক প্রোফাইলে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকুন।
  • সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের প্রাইভেসি সেটিংসগুলো ভালোভাবে কনফিগার করুন।

ওয়েবসাইট নিরাপদ কিনা, তা পরীক্ষা করুন

ওয়েবসাইটে ঢোকার আগে দেখে নিন সেটি নিরাপদ কিনা।

  • ওয়েবসাইটের ঠিকানার শুরুতে "https://" আছে কিনা, তা দেখুন। "https" মানে হলো ওয়েবসাইটটি সুরক্ষিত।
  • ব্রাউজারের অ্যাড্রেস বারে তালার আইকনটি দেখলে বুঝবেন ওয়েবসাইটটি এনক্রিপ্টেড এবং নিরাপদ।

কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর 

সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আপনার মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:

আমার ইমেইল আইডি হ্যাক হয়েছে কিনা, কিভাবে বুঝব?

যদি আপনার বন্ধুরা আপনার ইমেইল থেকে স্প্যাম মেসেজ পায় অথবা আপনি দেখেন আপনার পাঠানো ইমেইলগুলোর মধ্যে কিছু আপনি পাঠাননি, তাহলে বুঝবেন আপনার ইমেইল আইডি হ্যাক হয়েছে।

হ্যাকিং থেকে বাঁচার জন্য কোন অ্যান্টিভাইরাসটি ভালো?

বাজারে অনেক ভালো অ্যান্টিভাইরাস রয়েছে, যেমন – Norton, Bitdefender, Kaspersky ইত্যাদি। আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী একটি বেছে নিতে পারেন।

ফিশিং লিঙ্ক চেনার উপায় কী?

ফিশিং লিঙ্কগুলো সাধারণত দেখতে আসল ওয়েবসাইটের মতো হয়, কিন্তু এদের URL সামান্য ভিন্ন হয়। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে পার্থক্য ধরা পড়ে। এছাড়াও, ফিশিং ইমেইলগুলোতে প্রায়ই ভুল বানান এবং ব্যাকরণগত ভুল থাকে।

মোবাইল ফোন হ্যাক হওয়া থেকে বাঁচানোর উপায় কী?

  • প্লে স্টোর বা অ্যাপল স্টোর থেকে অ্যাপ ডাউনলোড করুন।
  • অপরিচিত লিঙ্ক বা অ্যা attachments ক্লিক করবেন না।
  • ফোনের সফটওয়্যার সবসময় আপডেট রাখুন।
  • পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহারের সময় ভিপিএন ব্যবহার করুন।

সাইবার বুলিং কী?

সাইবার বুলিং হলো অনলাইনে কাউকে হয়রানি বা উত্যক্ত করা। সোশ্যাল মিডিয়া বা মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে কাউকে খারাপ কথা বলা, হুমকি দেওয়া অথবা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া সাইবার বুলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত।

সাইবার নিরাপত্তা টিপস

  • নিয়মিত আপনার অনলাইন অ্যাকাউন্টগুলোর পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করুন।
  • অপরিচিত কাউকে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য দেবেন না।
  • অনলাইনে কোনো কিছু শেয়ার করার আগে দুবার ভাবুন।
  • সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং অন্যদেরকেও উৎসাহিত করুন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাইবার নিরাপত্তা

বাংলাদেশ সরকার সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে বেশ সচেতন। "ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮" প্রণয়ন করা হয়েছে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এছাড়াও, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করছে।

টেবিল: বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের কয়েকটি সাধারণ উদাহরণ

অপরাধের ধরন বর্ণনা প্রতিকার
ফিশিং ইমেইল বা মেসেজের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা সন্দেহজনক লিঙ্ক এড়িয়ে চলুন, রিপোর্ট করুন
র‍্যানসমওয়্যার কম্পিউটার বা মোবাইল লক করে মুক্তিপণ দাবি করা ব্যাকআপ রাখুন, অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করুন
ডেটা চুরি ব্যক্তিগত বা অফিসের ডেটা চুরি করা শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন, ফায়ারওয়াল ব্যবহার করুন
সাইবার বুলিং অনলাইনে হয়রানি বা উত্যক্ত করা অভিযোগ করুন, প্রমাণ সংগ্রহ করুন

সাইবার হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। একটু সচেতন হলেই আপনি আপনার ডিজিটাল জীবনকে নিরাপদ রাখতে পারেন। মনে রাখবেন, আপনার ডেটা আপনার সম্পদ, তাই এর সুরক্ষা আপনার হাতেই।

যদি আপনি সাইবার হামলার শিকার হন, তাহলে দেরি না করে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগে অভিযোগ করুন। আপনার সচেতনতা এবং সতর্কতা অন্যদেরকেও সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে।