টেলিকম ডিজিটাল ইনোভেশন ফেয়ার ২০২৫

‘দূরবীন’ শুধু অ্যাপ নয়, এটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জীবনসঙ্গী

Staff Reporter

মাহবুব শরীফ

শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:৪৭

‘দূরবীন’ শুধু অ্যাপ নয়, এটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জীবনসঙ্গী
ছবি: টেলিকম ডিজিটাল ইনোভেশন ফেয়ার ২০২৫-এ (ডানে) জেটটেক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা মোহাম্মদ সামিউল ইসলাম। ছবি : টেকওয়ার্ল্ড

সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত টেলিকম ডিজিটাল ইনোভেশন ফেয়ার ২০২৫-এ অংশ নেয় ২০টি প্রতিষ্ঠান, যারা উপস্থাপন করে ৩২টি নতুন উদ্ভাবন। প্রতিটি উদ্ভাবনই ছিল ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও প্রয়োজনকে ঘিরে, সমাজের নানা স্তরের মানুষের জীবনে প্রযুক্তির বাস্তব প্রভাব রাখার উদ্দেশ্যে।

এই আয়োজনে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান জেটটেক-এর উদ্ভাবন ‘দূরবীন এআই’, যা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের চলাফেরা, পড়ালেখা ও দৈনন্দিন জীবনযাপনকে সহজ ও স্বাধীন করতে তৈরি একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন।

এই উদ্ভাবনের ধারণা, কার্যকারিতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত জানতে জেটটেক-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা মোহাম্মদ সামিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছে টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : ‘দূরবীন এআই’ কী? এটি তৈরির পেছনের চিন্তা কী ছিল?

সামিউল ইসলাম: ‘দূরবীন’ একটি এআই-ভিত্তিক ইমেজ ও ভিডিও প্রসেসিং অ্যাপ, যা বিশেষভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও অল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য তৈরি। আমাদের মূল ভাবনা ছিল-একজন অন্ধ ব্যক্তি যেন অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই তার চারপাশের পরিবেশ বুঝতে পারেন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারেন। প্রযুক্তিকে মানবিক ও সামাজিক সহায়তা হিসেবে ব্যবহার করাই আমাদের উদ্দেশ্য।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : অ্যাপটি কীভাবে কাজ করে?

সামিউল ইসলাম: অ্যাপটি স্মার্টফোনের ক্যামেরা দিয়ে আশপাশের ছবি তুলে তা রিয়েল-টাইমে প্রসেস করে অডিও আকারে প্রেরণ করবে। এরপর অ্যাপটি চিনে ফেলে কোন বস্তু কোথায় আছে। আর সেটি ভয়েসের মাধ্যমে ব্যবহারকারীকে জানিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ- সামনে চেয়ার, দেয়াল, গাছ, বা চলন্ত গাড়ি থাকলে তা সবই বলে দেয়। এটি একটি দৃশ্য বিশ্লেষণ ও ভয়েস নির্দেশনা প্রদানকারী এআই সহকারি বলা চলে।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : এতে আর কী কী ফিচার রয়েছে?

সামিউল ইসলাম: অনেক কিছুই আছে। যেমন:বস্তু ও প্রতিবন্ধকতা শনাক্তকরণ সিস্টেম, বাংলাদেশি মুদ্রা শনাক্তকরণ; টাকা-পয়সা চিনে নিয়ে ভয়েসে জানিয়ে দেয় কোনটা কত টাকার। ছাপা লেখা ও টেক্সট পড়ে শোনানো; বই, ওষুধের মোড়ক, রেসিপি, অফিস নথি ইত্যাদি স্ক্যান করে পড়ে শোনায়। রিয়েল-টাইম গাইডেন্স; চলার পথে বাঁদিকে বা ডানদিকে ঘুরে চলতে বলবে, সামনে বাধা আছে কিনা সতর্ক করবে। এগুলো ছাড়াও ভবিষ্যতে আরও অনেক ফিচার যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : এটি কেবল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য?

সামিউল ইসলাম: প্রাথমিকভাবে এটি তাদের জন্যই তৈরি, তবে এর বহুমাত্রিক ব্যবহার রয়েছে। চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ফেস রিকগনিশন ও নজরদারির কাজে, নম্বর প্লেট শনাক্তকরণ, দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ইমিগ্রেশন ও সীমান্ত নিরাপত্তায় স্মার্ট আইডি যাচাই, ব্যাংকিং অ্যাক্সেসিবিলিটিতে ভয়েস গাইডেড লেনদেন, কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, এমনকি শিক্ষা খাতেও এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। 

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : কতজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এখন পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন?

সামিউল ইসলাম: আমরা এখন টেস্ট ফেইজে আছি। আপাতত ২০০ জন ব্যবহারকারী পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করছেন এবং প্রত্যেকেই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : এটি বিনামূল্যে দেওয়া হবে?

সামিউল ইসলাম: হ্যাঁ, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হবে। আমাদের দেশে লাখ লাখ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রয়েছেন, তারা যেন কোনো বাধা ছাড়াই এটি ব্যবহার করতে পারেন, সেটিই আমাদের অঙ্গীকার। আর্থিক সীমাবদ্ধতা যেন তাদের ডিজিটাল জীবনের পথে বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : এই উদ্ভাবনের পেছনে কারা কাজ করেছেন?

সামিউল ইসলাম: আমাদের একটি ছোট টিমে বর্তমানে ৪ জন এআই বিশেষজ্ঞ এই প্রজেক্টে কাজ করছেন। এটি বাস্তবায়ন করেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র (RIC)-এর তত্ত্বাবধানে, আইসিটি বিভাগের ইডিজিই প্রকল্প ও আইডিয়া প্রকল্প এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)-এর সহযোগিতায়।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

সামিউল ইসলাম: আমাদের স্বপ্ন দেশের প্রতিটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর কাছে ‘দূরবীন’ পৌঁছে দেওয়া। আমরা চাই, এই অ্যাপ শুধু প্রযুক্তি নয়, একটি সমাজ-পরিবর্তনকারী হাতিয়ার হোক। প্রয়োজন শুধু সঠিক সহযোগিতা ও অর্থায়ন। তখনই আমরা এটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে পারব।

টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ : আপনি এই উদ্ভাবনকে কীভাবে দেখছেন?

সামিউল ইসলাম: ‘দূরবীন’ কেবল একটি অ্যাপ নয়, এটি বাংলাদেশি উদ্ভাবনের এক প্রতীক। আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে প্রযুক্তিকে সহায়ক, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে। ‘দূরবীন’ সেই লক্ষ্যেই তৈরি। আমরা চাই প্রযুক্তি সবার জন্য হোক; বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য।