ছবি: সংগৃহীত
১৯ বছর বয়সী আতিকুল ইসলামের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা। তবে তার মুখের হাসি ম্লান হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ওই দিন বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার কাছে আতিকুলের হাতে গুলি লাগে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হাত হারানো পাঁচজন ব্যক্তিকে দেওয়া হলো দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রোবটিক হাত। এরা হলেন-যশোরের ডিপ্লোমা প্রকৌশলী আরিফ হোসেন সাগর, ডেমরায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে পুলিশের গুলিতে হাত হারানো মাদরাসা শিক্ষার্থী নজরুল ইসলাম, উত্তরায় বিক্রয় প্রতিনিধির কাজ করা তরুণ আতিকুল ইসলাম এবং মো. নাঈম হাসান।
এদের মধ্যে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের মোড়ে ৪ আগস্ট আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলো আরিফ হোসেন (সাগর)। এই মাদরাসা শিক্ষার্থীর হাতে যুবলীগের কর্মীরা কোপ দিয়েছিলেন। এক মাস পর বাঁ হাতটি কেটে ফেলতে হয়েছে। ডিপ্লোমা পাস করে একটি বায়িং হাউসে চাকরি করতেন আরিফ। চাকরিটা এখন আর নেই। এক বোন আর মা-বাবা আছেন।
২৫ বছর বয়সী নাঈম হাসানের বাড়ি যশোরে। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগের কর্মীদের ধারালো অস্ত্রের কোপে ডান হাতটি ঝুলে যায়। ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এভাবেই ঝুলে ছিল হাতটি। চিকিৎসায় চার লাখ টাকা খরচের পর হাতটি কেটে ফেলতে হয়েছে। এক বছর বয়সী একমাত্র মেয়ে নাজিফা জান্নাতকে কোলে নিতে পারেন না নাঈম।
১৯ বছর বয়সী আতিকুল ইসলামের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা। তবে তার মুখের হাসি ম্লান হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ওই দিন বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার কাছে আতিকুলের হাতে গুলি লাগে।
এছাড়াও কোরআনে হাফেজ মো. হোসাইন আহমেদ (২০) আরবি ও বাংলা লেখার জন্য বেশ প্রশংসা পেতেন। গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশ একদম কাছ থেকে তার ডান হাতে গুলি করে। পরদিন গুলি লাগা হাতটি কেটে ফেলতে হয়। বাবা নেই। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। সেই চাকরি চলে গেছে।
আর ট্রাক্টর চালক ভৈরবের মামুন মিয়া হাত হারিয়েছেন ১৯ জুলাই, জুম্মাবার। সেদিন নামাজের পর আন্দোলনে গেলে অস্ত্রধারীরা তার হাতে কোপ দেয়। ২৫ জুলাই হাত কেটে ফেলতে হয়। আট বছর বয়সী ছেলে এবং পাঁচ বছর বয়সী এক মেয়ের বাবা মামুন মিয়া এখন এক হাতে ট্রাক্টর চালাতে পারেন না। কাজ করতে না পারায় সংসারে অনটন দেখা দিয়েছে। এরওপর সাম্প্রতিক সময়ে নতুন বাংলাদেশের জন্য শঙ্কা তৈরি হয়েছে মনে।
বৃহস্পতিবার আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অঙ্গ হারানো এই ৫ তরুণের কৃত্রিম হাত সংযোজন করা হয়। হাত সংযোজন করেন রোবোলাইফ টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জয় বড়ুয়া লাভলু।
তিনি জানিয়েছেন, প্রযুক্তিতে তৈরি রোবটিক হাতগুলোর দাম ৩০ থেকে ১ লাখ টাকার মতো। এর মধ্যে কোনটি ব্রেইনের মাধ্যমে আবার কোনটি অটোমেটেড সুইচের মাধ্যমেও করা যাবে হাতের নিয়ন্ত্রণ।
অনুষ্ঠানে জয় বড়ুয়া পাঁচ তরুণের কৃত্রিম হাত লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন, কনুইয়ের নিচ থেকে হাত কাটা গেলে ব্রেন কন্ট্রোল আর কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা গেলে অটো কন্ট্রোলের কৃত্রিম হাত লাগানো হয়। প্রত্যেকের জন্য আলাদা মাপের হাত বানাতে হয়। হাতটি খুব ভারী নয়। ফলে ব্যবহারকারী দীর্ঘ সময় এটি ব্যবহার করতে পারেন। আর এই হাতের যেকোনো সমস্যায় আজীবন তাদেরকে সহায়তা করবেন তিনি।
এতে কিছুটা হলেও যাপিত জীবন সহজ করবে বলে মনে করেন আহতরা। হাত নেই, এই অনুভূতি থেকে খানিকটা মুক্তি মিলবে তাদের। খাওয়াসহ দৈনন্দিন কিছু কাজ করতে পারবেন এই হাত দিয়েই। এক কেজি ওজনের যেকোনো কিছু তুলতে পারবেন তারা। তবে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে ভয় পাচ্ছেন তারা। পঙ্গু জীবনে খেয়ে-পরে বাঁচতে সরকারের কাছে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা চান তারা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে আইসিটি সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, রোবোটিক এই হাত তাদের জীবন আগের মতো পুরোপুরি স্বাভাবিক করতে না পারলেও অনেকাংশেই সহযোগীতা করবে বিভিন্ন কাজে। সেইসাথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাদের যে অবদান, তা বিবেচনায় রেখে তাদের জন্য সম্ভাব্য সকল উদ্যোগ নেবে সরকার।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হাত হারানো পাঁচজন ব্যক্তিকে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রোবটিক হাত সংযোজন অনুষ্ঠান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্ভাবনী অনুদানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের একমাত্র রোবটিক হাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রোবোলাইফ টেকনোলজিস। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ জনের বেশি মানুষকে রোবটিক হাত সংযোজন করেছে। এছাড়াও সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, এবং ভারতসহ বাইরের চারটি দেশে এই রোবটিক হাত ডেমো প্রোডাক্ট হিসেবে রপ্তানি করেছে এই প্রতিষ্ঠান। এই কাজে ল্যাবটির সহযোগী হয়েছে ব্যাবিলন গ্রুপ।
প্রসঙ্গত, রোবোটিক হাত সংযোজন কার্যক্রমের জন্য বিশ্বের শীর্ষ ১০ তরুণ রোবট গবেষকদের জায়গায় নাম প্রকাশ পেয়েছে রোবোলাইফ টেকনোলজিস-এর ফাউন্ডার জয় বড়ুয়া লাভলুর।
উজ্জ্বল এ গমেজ
অধ্যাপক ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। গবেষক ও ডিজিটাল হেলথ সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ। উদ্ভাবন...