১১ ঘন্টা আগে
১২ ঘন্টা আগে
১৩ ঘন্টা আগে
১৪ ঘন্টা আগে
ছবি: টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ
প্রতিনিয়তই আমরা বিভিন্ন ধরনের সাইবার ঝুঁকির মধ্যে পড়ছি। প্রযুক্তির যুগে আমাদের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব জায়গাতেই কাজ করতে হচ্ছে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেটের সাহায্যে। ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ইন্টারনেটের সাহায্যে কাজ করতে গিয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। আর এসব সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন পিসিতে ইনস্টল করতে গিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাচ্ছে গুগলসহ বিভিন্ন থার্ট পার্টির কাছে।
হ্যাকাররা কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে হ্যাকিং করার ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, মেসেঞ্জার, ই-মেইলে বিভিন্ন ধরনের ফিশিং মেইল, ভিডিও মেসেজ, গিফট মেসেজ আকর্ষণীয় অফার লিংক পাঠায়। হ্যাকারদের পাতা এই প্রতারণার ফাঁদে যখন আপনি পা দেবেন বা ক্লিক করবেন, এমন কী কোনো অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করবেন, তখন আপনার অজান্তেই আপনার ডিভাইসের এক্সেস ও সমস্ত তথ্য চলে যাবে এই হ্যাকারদের দখলে। আপনি বুঝতেও পারলেন না যে, কীভাবে আপনার অজান্তে ডিভাইসের এক্সেস দিয়ে দিলেন হ্যাকারদের হাতে। হ্যাকাররা তখন আপনার ডিভাইসের প্রয়োজনীয় সব তথ্য, ছবি, ভিডিও ইত্যাদির এক্সেস পেয়ে যাবে। এভাবেই নিয়মিত আপনাকে মনিটরিংয়ে রাখে হ্যাকাররা । পরে প্রয়োজন মতো আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে ওই হ্যাকারের দল।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের সঙ্গে একান্ত আলাপে কথাগুলো বলেছেন ডিকোডস ল্যাব লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সার্টিফায়েড ইথিক্যাল হ্যাকার এবং সাইবার সিকিউরিটি প্রশিক্ষক আরিফ মঈনুদ্দীন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি দেশের বিভিন্ন আইটি ফার্মে ইনফরমেশন ও সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করে আসছেন। দেশের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন প্রয়োগকারি সংস্থা যেমন, র্যাব, পিবিআই, ডিএমপি, সিএমপি, বিএমপি, এটিইউ, সিআইডি ও ডিস্ট্রিক পুলিশ এবং আইসিটি ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সাইবার সিকিউরিটি, নেটওয়ার্ক ও ডাটা সার্ভার সিকিউরিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন। তিনি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল ফরেন্সিকের ওপর সিলেবাস প্রণয়ন ও মানদণ্ড নির্ধারণ কমিটির সদস্য।
সম্প্রতি রাজধানীর পান্থপথে ডিকোডস ল্যাবের অফিসে সাইবার সিকিউরিটির বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলেন সার্টিফাইড ও প্রফেশনাল ইথিক্যাল হ্যাকার আরিফ মঈনুদ্দীন। আলোচনায় উঠে আসে দেশের সাইবার সিকিউরিটির বিভিন্ন দিক। দীর্ঘ আলাপের চুম্বক অংশ এখানে টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: সময়ের পরিবর্তনে দেশের প্রায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ওয়েবসাইট ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে। এ সময়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাইবার সিকিউরিটির সচেতনতা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু রয়েছে বলে মনে করেন?
আরিফ মঈনুদ্দীন: দেখুন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে সারাবিশ্বে সাইবার আক্রমণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে জাতীয় নিরাপত্তা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এ থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছে না ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, এমনকি সরকারি ওয়েবসাইটও। বর্তমানে আমাদের সবকিছু ডিজিটালাইজড। আমরা এখন অফিসে স্যালারি পাই সেটাও কোনো না কোনো ইন্টারনেট সার্ভিসের মাধ্যমে। সুতরাং আমাকে যেহেতু সেই ইন্টারনেটকে অ্যাডপ করতে হচ্ছে, তাই ওই প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে হবে আমাকে। আমি যদি প্রযুক্তি সম্পর্কে না জানি এবং সেটা ব্যবহারে অভ্যস্ত না হই, তাহলে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির আশঙ্কা থেকেই যায়।
যেমন হতে পারে, আমাদের ব্যক্তিগত বা অফিসিয়াল জীবন। প্রতিনিয়তই আমরা বিভিন্ন ধরনের সাইবার ঝুঁকির মধ্যে পড়ছি। প্রযুক্তির যুগে আমাদের স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব জায়গাতেই কাজ করতে হচ্ছে ব্রডব্যান্ড ও মোবাইল ইন্টারনেটের সাহায্যে। ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ইন্টারনেটের সাহায্যে কাজ করতে গিয়ে ব্যবহার করতে হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, বিভিন্ন ধরনের সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। আর এসব সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন পিসিতে ইনস্টল করতে গিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাচ্ছে গুগলসহ বিভিন্ন থার্ট পার্টির কাছে। অফিস আদালতে কাজ করতে গেলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এসব বিষয়ে সঠিকভাবে ধারণা না থাকলে ব্যক্তি ও কোম্পানি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
এর জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের প্রথম কাজ হচ্ছে, এই প্রযুক্তিগুলো কীভাবে কাজ করে এবং এগুলো সিকিউর করার কোন কোন কৌশল বা পথ আছে, যেটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সে বিষয়গুলো আগে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শেখাতে হবে। যদি তারা এ বিষয়গুলো সম্পর্ক জানতে পারে, তাহলেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। সেইসঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানকেও সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে পারবে। তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য সাইবার সিকিউরিটির সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: এসব প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ও সার্ভারগুলো কতটুকু সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত বলে মনে করেন?
আরিফ মঈনুদ্দীন: একটা প্রতিষ্ঠানের যেসব আইটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার, সিস্টেম, অ্যাপ্লিকেশন ও সার্ভার রয়েছে সেগুলো কতটুকু সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত বা সুরক্ষিত সেটা তখনই বলতে পারব, যখন ওই সিস্টেমের দুর্বলতাগুলো আইডেন্টিফাই করতে পারব। যতক্ষণ পর্যন্ত এটা আইডেন্টিফাই করতে না পারব, ততক্ষণ পর্যন্ত বলতে পারব না যে, এটা সুরক্ষিত বা নিরাপদ কি-না। তাহলে এই নিরাপদ করার পথ কী? পথ হলো, নিয়মিত ভালনারেবিলির্টি অ্যাসেসমেন্ট এবং পেনিট্রেশন টেস্টিং করা। এর মাধ্যমে আমাদের এই অ্যাপ্লিকেশন সিস্টেমে বা নেটওয়ার্কে কি কি ধরনের দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো আইডেন্টিফাই করা যাবে। আমি যখন সেই দুর্বলতাগুলো আইডেন্টিফাই করতে পারব, তখন আমি বুঝতে পারব যে, এই সিস্টেম কতভাবে হ্যাক হতে পারে। তখন আমি সেই হ্যাকিংটাকে প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপগুলো নিতে পারব।
আইটিতে একটা নিয়ম আছে প্রতি ৩/৬ মাসে একবার করে কোম্পানির সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক পেনিট্রেশন টেস্ট করা। যেসব প্রতিষ্ঠানে এ পরীক্ষা করানোর মতো আইটি এক্সপার্ট নেই, তাদের অন্য কোম্পানি থেকে হায়ার করে এনে টেস্ট করাতে হয়। শুধু নেটওয়ার্ক টেস্ট করলেই হবে না। এর সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানে যেসব অ্যাপ্লিকেশন বা যে সিস্টেম আছে সেগুলো প্রতিবার পরীক্ষা করতে হবে। দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধান করতে হবে। আপনি যে প্রযুক্তি বা সিস্টেম ব্যবহার করছেন, সেটা নিয়মিত আপডেট করতে হবে। যখনই যে আপডেট আসছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে আপডেট করে নিতে হবে। একটা ভার্সন বার বার আপডেট করে কেনো? কারণ আগের সিস্টেমে দুর্বলতা আছে এবং সেটাকে সিকিউর করার জন্য আপডেট করে থাকে। এখন সেটা যদি আপনি আপডেট না করেন, তাহলে ওই সফটওয়্যার ভার্সনের সিস্টেমের যে দুর্বলতা আছে সে সুযোগটা নিয়ে হ্যাকাররা আপনার সিস্টেমকে আক্রমণ করতে পারে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ও সার্ভারগুলো সাইবার আক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত রাখার উপায় কী?
আরিফ মঈনুদ্দীন: আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত কম্পিউটার উইন্ডোজের জন্য ক্র্যাক অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করে থাকে। এই সিস্টেম ব্যবহার করা মানে আমার পিসির স্বাধীনতা সুরক্ষা আরেকজনের হাতে তুলে দেওয়া। আমি যদি মাক্রোসফটের অফিসিয়াল উইন্ডোজ ১১ কিনতে চাই, তার দাম পড়বে কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা। এখন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন ১০ হাজার টাকা দিয়ে একটা উইন্ডোজ এর লাইসেন্স কিনব, কম্পিউটার উইন্ডোজের জন্য তো ক্র্যাক অপারেটিং সিস্টেমই যথেষ্ট। এটি দিয়েই তো কাজ চালানো যাচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যদি এমন চিন্তা থেকে থাকে, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এখন আসি নেটওয়ার্ক ও ডাটা সার্ভারের সুরক্ষার বিষয়ে। একটা প্রতিষ্ঠানের মেইন সার্ভারে সব ডাটা সংরক্ষিত থাকে। এখানে বিভিন্ন ধরনের সার্ভিস রয়েছে। এগুলোর নিরাপত্তার জন্য নেক্সট জেনারেশন ফায়ারওয়াল টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে। ইনট্রুশান ডিটেকশন সিস্টেম ব্যবহার করা, পেইড এন্টিভাইরাস ব্যবহার করা, পেইড উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা, রিয়েলটাইম থ্রেট এনালাইসিস এর জন্য এসআইইএস (SIEM) সল্যুশনস ব্যবহার করা ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানে এসব সিস্টেম ইমপ্লিমেন্ট করতে একটা বড় অংকের বাজেটের প্রয়োজন হয়। সেটা যদি কর্তৃপক্ষ দিতে না চায়, তাহলে প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক ও ডাটা সার্ভারের সুরক্ষিত থাকার চেয়ে অরক্ষিতই থেকে যাবে। তাই এমন অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কিছু পলিসিগত দিকে নজর দিতে হবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: আমাদের ব্যাংকিং সেক্টরে হ্যাকিংয়ের ঘটনা কেনো ঘটছে? সমস্যার সমাধানে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
আরিফ মঈনুদ্দীন: বর্তমানে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো অনলাইনে লেন-দেন করছে। সব ব্যাংক তো আর তাদের সার্ভারের সাইবার সিকিউরিটির জন্য আপডেটেড টেকনোলজি ব্যবহার করছে না। করলেও সব সময় সাইবার সিকিউরিটির ইস্যুটিতে সতর্ক থাকছে না। তাই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে। তবে আশার কথা হলো, ব্যাংকগুলো তাদের সিস্টেমের সিকিউরিটির জন্য বিভিন্ন সময়োপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ডেভেলপ করছে। ব্যাংকগুলোতে এসব আপডেটেড টেকনোলজি ব্যবহারে অভ্যস্ত করাটা সময়ের ব্যাপার। প্রতিনিয়ত সিস্টেম আপডেট ও মনিটরিংয়ে রাখতে হবে। সিস্টেমের দুর্বলতা আইডেন্টিফাই করে সেগুলো ফিক্স করতে হবে, বিভিন্ন পলিসি ও ফ্রেমওয়ার্ক ইমপ্লিমেন্ট করতে হবে। ডেটা ব্যাকআপ রাখতে হবে। এনক্রিপশন সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: সাইবার ওয়ার্ল্ডে হ্যাকারদের হাত থেকে ব্যক্তিকে সিকিউর রাখার কৌশলগুলো জানতে চাই।
আরিফ মঈনুদ্দীন: সাইবার ওয়ার্ল্ডে নিজেকে সিকিউর করতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। হ্যাকাররা তাদের টার্গেটকৃত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে হ্যাকিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের টেকনিক ব্যবহার করে থাকে। টেকনিকগুলো হলো-হ্যাকাররা হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, মেসেঞ্জার, ইমেইলে বিভিন্ন ধরনের ফিশিং মেইল, গিফটের মেসেজ লিংক, অফার লিংক পাঠায়। এসব লিংকে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় অফার থাকে। যেমন, আপনি এই লিংকে ক্লিক করলে বিকাশের আর্কষণীয় লটারি জিতে নিতে পারবেন। ১৫ হাজার টাকার স্মার্টফোন পাচ্ছেন মাত্র ৭ হাজার টাকায়। এখানে ক্লিক করলে আপনি এত টাকা বোনাস পাবেন। হ্যাকারদের পাতা এই প্রতারণার ফাঁদে যখন কোন ব্যক্তি পা দেয় বা ক্লিক করেন, তখন তার সমস্ত তথ্য চলে যায় হ্যাকারদের দখলে। ব্যক্তি বুঝতেও পারেন না যে, নিজের অজান্তেই তার ডিভাইসের এক্সেস চলে গেছে ওই হ্যাকারের দখলে।
তাই ভুল করেও অপরিচিত বা থার্ড পার্টির দেওয়া কোনো মেইল বা এটাচমেন্ট বা কোনো ফেসবুকের লিংক বা কোনো গান বা কোনো কিছুতেই ক্লিক করা যাবে না। সেইসঙ্গে যুগের সাথে তাল মেলাতে নিজেকে প্রযুক্তিতে আপডেটেড ও ডেভেলপ করতে হবে। নিজের উদ্যোগে সময়োপযোগী ট্রেনিং নিতে হবে। যেসব ইনস্টিটিউট সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে ট্রেনিং দিচ্ছে, তাদের কাছ থেকে ট্রেনিং নিতে হবে। নিত্যদিনের ব্যবহার্য ডিভাইস, আইটি পণ্য, একসেসরিজ কী করলে নিরাপদ ও সুরক্ষিত রাখা যায় সে বিষয়ে ইন্টারনেট থেকে জেনে নিতে হবে। কর্মকর্তা কমর্চারিদের সাইবার অপরাধের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। এ বিষয়গুলো জানার কোন বিকল্প নেই।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষিত রাখতে কোন কোন দিকে বিশেষ নজর দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন?
আরিফ মঈনুদ্দীন: হ্যাকারদের আক্রমণ থেকে প্রতিষ্ঠানকে সুরক্ষিত রাখতে একটা দক্ষ আইটি টিম তৈরি করতে হবে। টিমটা তৈরিতে একটু কৌশলী হতে হবে। যেমন, প্রতিষ্ঠানের টেক এমপ্লয়িদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ দিয়ে টিম তৈরি করতে হবে যাতে, তারা যেকোনো বিষয় দ্রুত শিখতে পারে। তাই কোম্পানির সাইবার সিকিউরিটি ডেভেলপমেন্টে নতুনদের অগ্রাধিকার দেওয়াটা জরুরি। প্রতিনিয়ত তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর সিস্টেমে আপডেট রাখতে হবে।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের জন্য যেকোনো ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করি না কেনো, সেটা পরিপূর্ণভাবে টেস্ট বা পরীক্ষা না করে অনলাইনে দেওয়া যাবে না। পরীক্ষা করার পর যে ধরনের দুর্বলতাগুলো রয়েছে সেগুলো সমাধান করে, তারপরে অনলাইনে দিতে হবে। তা না হলে ওই প্রতিষ্ঠান যেকোনো মুহূর্তে হ্যাকিংয়ের শিকার হতে পারে।
এছাড়াও আইটিতে একটা নিয়ম আছে প্রতি ৩/৬ মাসে একবার করে কোম্পানির সিস্টেম বা নেটওয়ার্ক পেনিট্রেশন টেস্ট করা। যেসব প্রতিষ্ঠানে এ পরীক্ষা করানোর মতো আইটি এক্সপার্ট নেই, তাদের অন্য কোম্পানি থেকে হায়ার করে এনে টেস্ট করাতে হয়। শুধু নেটওয়ার্ক টেস্ট করলেই হবে না। এর সঙ্গে আমাদের প্রতিষ্ঠানে যেসব অ্যাপ্লিকেশন বা যে সিস্টেম আছে সেগুলো প্রতিবার পরীক্ষা করতে হবে। দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো সমাধান করতে হবে। আপনি যে প্রযুক্তি বা সিস্টেম ব্যবহার করছেন, সেটা নিয়মিত আপডেট করতে হবে। যখনই যে আপডেট আসছে সেটা সঙ্গে সঙ্গে আপডেট করে নিতে হবে। একটা ভার্সন বার বার আপডেট করে কেনো? কারণ আগের সিস্টেমে দুর্বলতা আছে এবং সেটাকে সিকিউর করার জন্য আপডেট করে থাকে। এখন সেটা যদি আপনি আপডেট না করেন, তাহলে ওই সফটওয়্যার ভার্সনের সিস্টেমের যে দুর্বলতা আছে সে সুযোগটা নিয়ে হ্যাকাররা আপনার সিস্টেমকে আক্রমণ করতে পারে।
টেকনিকগুলো হলো-হ্যাকাররা হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, মেসেঞ্জার, ইমেইলে বিভিন্ন ধরনের ফিশিং মেইল, গিফটের মেসেজ লিংক, অফার লিংক পাঠায়। এসব লিংকে বিভিন্ন ধরনের লোভনীয় অফার থাকে। যেমন, আপনি এই লিংকে ক্লিক করলে বিকাশের আর্কষণীয় লটারি জিতে নিতে পারবেন। ১৫ হাজার টাকার স্মার্টফোন পাচ্ছেন মাত্র ৭ হাজার টাকায়। এখানে ক্লিক করলে আপনি এত টাকা বোনাস পাবেন। হ্যাকারদের পাতা এই প্রতারণার ফাঁদে যখন কোন ব্যক্তি পা দেয় বা ক্লিক করেন, তখন তার সমস্ত তথ্য চলে যায় হ্যাকারদের দখলে। ব্যক্তি বুঝতেও পারেন না যে, নিজের অজান্তেই তার ডিভাইসের এক্সেস চলে গেছে ওই হ্যাকারের দখলে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: একজন সাইবার সিকিউরিটি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সাধারণ মানুষদের জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন কি?
আরিফ মঈনুদ্দীন: আপনি জেনে থাকবেন আমাদের ডিকোডস ল্যাবের মাধ্যমে সারাদেশের সাইবার সিকিউরিটি ও আইটির সিকিউরিটি বিষয়ে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ট্রেনিং দিয়ে থাকি। আমাদের দক্ষ একটা টিম আছে, যারা প্রতিনিয়ত নিজেরাও শিখছে এবং অন্যদেরকেও শেখাচ্ছেন। আমাদের কাছ থেকে আইটি সিকিউরিটির বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং কোর্স করে যে কেউ নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারবেন। ট্রেনিং শেষে শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেট দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জব-এর ব্যবস্থাও করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে তথ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ওয়ার্কশপ ও সেমিনার পরিচালনা এবং দেশের প্রধান টিভি, প্রিন্ট, অনলাইন মিডিয়াতে সাক্ষাৎকার দেই। সেইসঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির দুর্বলতা মূল্যায়ন ও পেনিট্রেশন টেস্টিং, ডেটা প্রাইভেসি মূল্যায়ন ও কনসালটেন্সি করছি। অন্যদিকে সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের পরামর্শও দিয়ে থাকি।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: সাইবার জগতে নিরাপত্তার ঝুঁকি ও সচেতনতা নিয়ে আপনার লেখা বইগুলো সম্পর্কে জানতে চাই।
আরিফ মঈনুদ্দীন: একটা দীর্ঘ সময় ধরে আমি দেশে ও বিদেশে, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, আইটি ফার্ম ও গোয়েন্দা সংস্থাতে ট্রেনিং দিয়ে আসছি। এসব প্রতিষ্ঠানে ট্রেনিং দেওয়ার সময় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও গৌষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে ‘সাইবার সিকিউরিটি’, ‘সাইবার হ্যাকিং অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’, ‘ডিজিটাল ফরেনসিক অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন’ নামে বই লিখেছি। এছাড়া সাইবার অপরাধের বিভিন্ন কেসস্টাডি নিয়ে ‘সাইবার অপরাধনামা’ বই প্রকাশিত হয়েছে। যে কেউ বইগুলো পড়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: জেনেছি আপনি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে সাইবার সিকিউরিটির সিলেবাস তৈরিতে যুক্ত আছেন. . .
আরিফ মঈনুদ্দীন: আসলেই সঠিকটাই জেনেছেন। আমি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল ফরেন্সিকের ওপর সিলেবাস প্রণয়ন ও মানদণ্ড নির্ধারণ কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমরা বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধীনে সাইবার সিকিউরিটি ও ডিজিটাল ফরেন্সিকের ওপর একটা সিলেবাস প্রণয়নে কাজ করেছি। ২০২৪ সাল থেকে সিলেবাস অনুসারে ক্লাস শুরু করা হবে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এক বছর মেয়াদী কোর্সের জন্য এ সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে। কোর্স করার জন্য শিক্ষার্থীকে এইচএসসি পাস করতে হবে। অনার্স বা বিএসসি পড়ার সময়ও এটি করা যাবে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় না, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড-এর অনুমোদন নিয়ে সরকারি অনুমোদিত ট্রেনিং সেন্টারগুলোও এই সিলেবাস অনুসারে কোর্স পরিচালনা করতে পারবে। কোর্স শেষে ফাইনাল পরীক্ষাটা বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে নেওয়া হবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান?
আরিফ মঈনুদ্দীন: যেহেতু সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কাজ করছি, তাই বাংলাদেশকে একটি সুরক্ষিত ও সাইবার অপরাধমুক্ত স্মার্ট দেশ হিসেবে দেখতে চাই। যেখানে দেশের প্রতিটি নাগরিক নিরাপদে তাদের অনলাইনে পড়াশোনা, অফিস-আদালতের কাজ, সোশ্যাল মিডিয়া চালানো, ভার্চুয়াল জগতে সব কিছু যেন নিরাপদে করতে পারেন। সব কিছু যেন স্বাধীনভাবে করতে পারেন। দেশের সাইবার জগৎ হোক, নিরাপদ ও সুরক্ষিত। এমনটাই প্রত্যাশা আমার।
উজ্জ্বল এ গমেজ
অধ্যাপক ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। গবেষক ও ডিজিটাল হেলথ সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ। উদ্ভাবন...