বৃহস্পতিবার

ঢাকা, ৫ অক্টোবর ২০২৩

লেটেস্ট আপডেট


বিশেষ প্রতিবেদন

ই-বর্জ্য সংগ্রহে কোনো কার্যকর পদ্ধতি চালু করেনি দেশের মোবাইল ফোন কোম্পানি

প্রকাশ: ৮ আগস্ট ২০২৩, রাত ১০:৫১

টেকওয়ার্ল্ড প্রতিবেদক
Card image

Card image

ছবি: সংগৃহীত

বাস্তবে এই নীতিমালার প্রয়োগ নেই সেভাবে। ই-বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনের প্রচলনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি।  এছাড়া, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে এটি সংগ্রহের চ্যানেলও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং একইসাথে অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া অমিত সম্ভাবনার ই-বর্জ্যের ব্যবসা।  

মোবাইল ফোন ছাড়া আমরা এখন একটি দিনও ভাবতে পারি না। কিন্তু দুই যুগ আগেও এ যন্ত্রটির সাথে মানুষের তেমন কোন পরিচয় ছিল না। সময়ের পালা-বদলে এটি আমাদের জীবনের সঙ্গে যেভাবে মিশে গেছে, সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো উদ্ভাবন এত বিকশিত হয়নি।

১৭ কোটি মানুষের এই দেশে ১৮.৫১ কোটি মুঠোফোন গ্রাহক রয়েছে। এখন স্থানীয় ও গ্লোবাল মিলে ১৬টি কোম্পানি মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদন করছে। ২০২২ সালে এগুলোতে উৎপাদন করা হয় প্রায় তিন কোটি মোবাইল হ্যান্ডসেট। ২০২২ সালে প্রতি মাসে উৎপাদন করা হতো প্রায় ৩৩ লাখ। ২০২৩ সালে এসে এখন সেটি ১৪ লাখে নেমে এসেছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এই মোবাইল ফোন নিত্যদিনের অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। জীবনের প্রয়োজনে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া সব শ্রেণির মানুষই মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে।   

জনবহুল এই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অসংখ্য মানুষের ঘরে ঘরে অচল, বাতিল বা ব্যবহারের অনুপযোগী মোবাইল ফোন ই-বর্জ্য হিসেবে পড়ে আছে। এসব ফোনগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে সংগ্রহ করে বিটিআরসির লাইসেন্স প্রাপ্ত রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করার নীতিমালা রয়েছে।   

বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা থাকলেও উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো সে অনুসারে মোবাইল ফোন ই-বর্জ্য সংগ্রহ করছে না। ফলে দেশে বিপুল পরিমাণে ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ই-বর্জ্যের কারণে দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ই-বর্জ্যে উদ্বেগজনক মাত্রায় বিষাক্ত উপাদান যেমন, সীসা, মার্কারি, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, বেরেলিয়াম ইত্যাদি থাকে। এসব বিষাক্ত বস্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, ব্রেইন, হার্ট ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইকো সিস্টেম নষ্ট করে। ইলেকট্রনিক পণ্যসামগ্রী ব্যবহারের ক্রম ঊর্ধ্বমুখিতায় ই-বর্জ্যের পরিমাণ ও ক্ষতিকর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাস্তবে এই নীতিমালার প্রয়োগ নেই সেভাবে। ই-বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনের প্রচলনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এছাড়া, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে এটি সংগ্রহের চ্যানেলও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং একইসাথে অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া অমিত সম্ভাবনার ই-বর্জ্যের ব্যবসা।  

অন্যদিকে, ২০১৮ সালের সিইআরএম-বুয়েটের সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ই-বর্জ্যে থাকে সীসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি)-র মতো বিষাক্ত ও ক্ষতিকর উপাদান। আরও থাকে পলিব্রোমিনেটেড ডিফাইনিল ইথার এবং পলিব্রোমিনেটেড বাইফেনিল-এর মতো অর্গানিক উপাদান, যা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশ দূষণের কারণ হয়। ই-বর্জ্য পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। দেশে যথাযথ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় দূষিত করছে পানি, বায়ু এবং মাটি। বাড়াচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং বিনষ্ট করছে জমির উর্বরতাও।  

বিটিআরসির ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালায় ই-বর্জ্য সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, সবশেষ স্তরের ভোক্তা এবং এসব পণ্যের মেরামতকারীদের নিজস্ব খরচে ই-বর্জ্য অনুমোদিত রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এরপর অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে এসব পণ্য খুলে বা পৃথক করে পরিবেশ-সম্মত উপায়ে রিসাইক্লিংয়ের কাজ করবে। 

তবে বাস্তবে এই নীতিমালার প্রয়োগ নেই সেভাবে। ই-বর্জ্য সংগ্রহের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনের প্রচলনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এছাড়া, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে এটি সংগ্রহের চ্যানেলও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং একইসাথে অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া অমিত সম্ভাবনার ই-বর্জ্যের ব্যবসা।  

 ২০১১ সাল থেকে দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করছে জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্স লিমিটেড। পুনরুদ্ধার করা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেগুলি জাপান ও কাতারে রপ্তানি করছে কোম্পানিটি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হোসেন জুয়েল টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে  বলেন, মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বিটিআরসির ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসারে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোবাইল ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে না। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘরে পড়ে থাকা বাতিল মোবাইল ফোনগুলো সংগ্রহ করার কার্যকর কোন পদ্ধতি ও চ্যানেল বা সুনির্দিষ্ট কোনো ডাস্টবিনও এখনো পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়ে উঠেনি। শুধু ঢাকায় কোম্পানিগুলোর কারখানায় যেসব ই-বর্জ্য তৈরি হয় সেগুলো আমরা কিনে নেই। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের ই-বর্জ্য আমরা কখনও পাইনি। দেশে ১৭ কোটি মানুষের ঘরেই কিছু না কিছু বাতিল মোবাইল ফোন আছে। এসব ই-বর্জ্য থাকলেও সরকারের নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগের অভাবে ও  সংগ্রহের কার্যকর পদ্ধতি না থাকায় আমরা পর্যাপ্ত ই-বর্জ্য পাচ্ছি না। 

ই-ওয়েস্ট রিসাইক্লিং এই ইঞ্জিনিয়ার বলেন, মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো ঠিক পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য সংগ্রহ না করায় এখন ভ্যানে করে ভাঙ্গারি দোকানদাররা ছোট মাইক বাজিয়ে এসব নষ্ট ইলেকট্রনিকপণ্য সংগ্রহ করছে। তাদেরকে এগুলো সংগ্রহ করার জন্য ফাইনান্স করছে চাইনিজ ও ইন্ডিয়ান কিছু সংখ্যক ব্যক্তি। সংগ্রহকৃত কাঁচামাল মেশিনে প্রক্রিয়া করে গুরুত্বপূর্ণ কম্পনেন্টগুলো নিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে তারা। আমাদের ভাঙ্গারি দোকানগুলোর মাধ্যমে এ কার্যক্রমটা পরিচালিত হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে আমাদের দেশের ই-বর্জ্য বাইরে চলে যাচ্ছে। 

মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বিটিআরসির ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসারে গ্রাহকদের কাছ থেকে মোবাইল ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে না। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাহকদের কাছ থেকে ঘরে পড়ে থাকা বাতিল মোবাইল ফোনগুলি সংগ্রহ করার কার্যকর কোন পদ্ধতি ও চ্যানেল বা সুনির্দিষ্ট কোনো ডাস্টবিনও এখনো পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়ে উঠেনি।

ই-বর্জ্য গবেষকরা বলছেন, অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহে সস্তা ও ক্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি হয়। তাই সরকারের ই-বর্জ্য নীতিমালার যথাযত প্রয়োগ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারিই পারবে এমন অনিয়ম বন্ধ করতে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ট্রানশান হোল্ডিংস লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজওয়ানুল হক টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে  বলেন, দেখুন, সারাদেশের গ্রাহকদের ঘরে পড়ে থাকা বাতিল মোবাইল ফোন এখনও কেউ এভাবে সংগ্রহ করে না। আর সংগ্রহের কোন পদ্ধতিও প্রচলিত নেই। আমরা মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাচারিং অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ভোক্তাদের কাছে যেসব অচল, নষ্ট মোবাইল ফোন রয়েছে এগুলি সংগ্রহের জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় বক্স বসাবো। ব্যবহারকারীরা যাতে ওই নষ্ট মোবাইলটা বক্সে ফেলে যেতে পারে। আমরা বক্স বসিয়েছিলাম। আসলে আমাদের দেশের ভোক্তারা নিজের ইচ্ছায় এসে পুরানো মোবাইলটা বক্সে ফেলে দিয়ে যাবে। কখনও এ কাজটা কেউ করে না। আমরা এ উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ভোক্তাদের দিকে থেকে কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় আর বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠেনি।

টেলিকম বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দেশে বাসাবাড়ি থেকে গ্রাহকদের ব্যবহারের অযোগ্য বা অচল মোবাইল ফোনটি সংগ্রহের একটা কার্যকর পদ্ধতি বা মডেল শিগগিরই চালু করা সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। যেমন, প্রতিটি হ্যান্ডসেট বিক্রি করার সময় সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শোরুমে বিক্রয় প্রতিনিধি গ্রাহককে বলে দিবেন যে, আপনার হ্যান্ডসেট যখন ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাবে, তখন সেটি আমাদের শোরুমে  জমা দিয়ে নতুন ফোন কিনতে পারবেন। সেসাথে  নতুন ফোন কেনার সময় কিছু সুবিধা পাবেন। এই এক্সচেঞ্জ পদ্ধতিটা দেশের সব মোবাইল উৎপাদনকারী কোম্পানি চালু করলে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন কারো ফোন ব্যবহারের অযোগ্য হবে, তখন সাথে সাথে নির্দিষ্ট কোম্পানির শোরুমে জমা দিতে উৎসাহিত হবে।

২০১৭ সালে দেশে প্রথম মোবাইল উৎপাদন কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে এর সূচনা করে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন। দেশে কারখানা তৈরি করে মানুষের মোবাইল ফোনের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে কোম্পানিটি। রপ্তানিও করছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

মোবাইল ফোন ই-বর্জ্য সংগ্রহের বিষয়ে ওয়ালটন ডিজিটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মোবাইল রিসাইক্লিং বিভাগের বিজনেস ইনটেলিজেন্স ও নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল হাসান টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, দুটি পদ্ধতিতে আমাদের মোবাইল ই-বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। একটা হলো, ফ্যাক্টরি থেকে যেসব ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, অন্যটি আমাদের সার্ভিস সেন্টার থেকে আসে। বিটিআরসির অনুমোদিত আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে এসব ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করা হয়।

ওয়ালটন ডিজিটেকের এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, তবে সারাদেশের কাস্টমারদের ব্যবহার করার পর বাসায় পড় থাকা  বাতিল মোবাইল ফোন সংগ্রহ করার জন্য আমাদের কোন  টিম নেই। শুধু আমাদের সার্ভিস পয়েন্টে যেসব বাতিল মোবাইল আসে, সেগুলি আমরা সংরক্ষণ করতে পারি। পুরানো বাতিল  মোবাইল দিয়ে নতুন ফোন নেয়ার এক্সচেঞ্জ পদ্ধতিটা এখনও আমাদের চালু করা হয়নি। ঈদের পর মোবাইল এক্সচেঞ্জ পদ্ধতি নিয়ে সারাদেশে একটা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে।

দেখুন, সারাদেশের গ্রাহকদের ঘরে পড়ে থাকা বাতিল মোবাইল ফোন এখনও কেউ এভাবে সংগ্রহ করে না। আর সংগ্রহের কোন পদ্ধতিও প্রচলিত নেই। আমরা মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাচারিং অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, ভোক্তাদের কাছে যেসব অচল, নষ্ট মোবাইল ফোন রয়েছে এগুলো সংগ্রহের জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় বক্স বসাবো। ব্যবহারকারীরা যাতে ওই নষ্ট মোবাইলটা বক্সে ফেলে যেতে পারে। আমরা বক্স বসিয়েছিলাম। আসলে আমাদের দেশের ভোক্তারা নিজের ইচ্ছায় এসে পুরানো মোবাইলটা বক্সে ফেলে দিয়ে যাবে। কখনও এ কাজটা কেউ করে না। আমরা এ উদ্যোগকে বাস্তবায়নের জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ভোক্তাদের দিকে থেকে কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় আর বাস্তবায়ন করা হয়ে উঠেনি।

এডিসন গ্রুপের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে সিম্ফনি মোবাইল হ্যান্ডসেট ম্যানুফ্যাকচারিং করে বাংলাদেশে বাজারজাত করছে। স্মার্টফোন উৎপাদনকারী কোম্পানি হিসেবে বিটিআরসির নীতিমালা পালন করছে কি-না জানতে চাইলে সিম্ফনি মোবাইল ফোন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জাকারিয়া শাহিদ টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, আমরা ২০১৮ সাল থেকে দেশেই মোবাইল ফোন  উৎপাদন করছি। বিটিআরসির অনুমোদিত কিছু রিসাইক্লিং কোম্পানি আছে। এরকম একটি রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট  ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির সাথে সিম্ফনি মোবাইল চুক্তি  বদ্ধ। আমাদের কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে যেসব নষ্ট বা ফল্টি বলে গণ্য হয় সেই প্রডাক্টগুলো আমরা বিটিআরসির নীতমালা মেনে রিসাইক্লিং কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে বিটিআরসি থেকে একটি সার্টিফিকেট নিয়ে রাখি। 

এ প্রসঙ্গে শাওমি বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার জিয়াউদ্দিন চৌধুরী টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, স্মার্টফোন উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা সর্বদাই দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ই-বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বিটিআরসির নীতিমালা অনুযায়ী ফ্যাক্টরি প্রাঙ্গণে পণ্যসমূহ স্ক্র্যাপ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সেইসাথে সমস্ত কাজের রেকর্ড ও রিপোর্ট নির্দেশিত ফরম্যাটে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হবে।

উৎপাদনকারী কোম্পানি হিসেবে শাওমি বাংলাদেশ সারাদেশের গ্রাহকদের কাছ থেকে পুরাতন, ব্যবহারের অনুপযোগী মোবাইল ফোনগুলি বা মোবাইল ই-বর্জ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জিয়াউদ্দিন চৌধুরী আরও বলেন, বর্তমানে দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আমাদের সার্ভিস সেন্টারগুলো থেকে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে সেন্ট্রাল ওয়্যার হাউজে সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত এসব ই-বর্জ্য বিটিআরসি প্রদত্ত নীতিমালা মেনে নির্ধারিত ভেন্ডরকে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করার পর বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী ভেন্ডর স্ক্র্যাপ করে আমাদেরকে সনদপত্র দেয়।

২০১৯ সালের জুলাইতে ভিভো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টের উদ্বোধন করে। তখন থেকে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে মোবাইল হ্যান্ডসেট ম্যানুফ্যাকচারিং করে বাংলাদেশে বাজারজাত করছে গ্লোবাল ব্র্যান্ডটি। ভিভোর কান্ট্রি ব্র‍্যান্ড ম্যানেজার তানজীব আহমেদ টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, ব্যবহৃত ইলেকট্রনিকস পণ্য রিসাইক্লিং করার জন্য বিটিআরসির যেসব লাইসেন্সকৃত রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আছে সেখান থেকে একটাতে আমাদের মোবাইল ই-বর্জ্য সেল করি। গত মাসে বিটিআরসির পক্ষ থেকে আমাদের কোম্পানি  পরিদর্শন করে গেছে। তখন গ্লোবাল কোম্পানি হিসেবে আমাদের মাটি ও পরিবেশ কীভাবে দূষণমুক্ত রাখা যায় সে বিষয়ে তাদের সাথে আলাপ করি। আমরা সরকারের তৈরিকৃত নীতিমালা প্রতি সন্তোষ্ট। 

উন্নত বিশ্বে মোবাইল হ্যান্ডসেট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির জন্য গ্রাহকদের ব্যবহৃত নষ্ট, অচল মোবাইল হ্যান্ডসেট ই-বর্জ্য সংগ্রহে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) নীতিমালা রয়েছে। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে উৎপাদিত ইলেকট্রিক/ইলেকট্রনিক্স বা মোবাইল হ্যান্ডসেট ই-বর্জ্য গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। 

বর্তমানে দেশের মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলি কীভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেটের ই-বর্জ্য সংরক্ষণ করছে? জানতে চাইলে বিটিআরসির কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, যেসব মোবাইল হ্যান্ডসেট ই-বর্জ্য হিসেবে পরিণত হয় সেগুলি সংরক্ষণের জন্য আমাদের কমিশনের ১০টি রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট  ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আছে। এসব কোম্পানিগুলি বাতিল, ব্যবহারের অযোগ্য মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলি সংরক্ষণ করে থাকে। এছাড়াও মোবাইল হ্যান্ডসেট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলিও তাদের কাস্টমার কেয়ারের মাধ্যমে পুরানো, বাতিল ও ব্যবহারের অযোগ্য মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলি সংগ্রহ করে থাকে। 

প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ বলেন, আমাদের কমিশনের পক্ষ থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলোর প্রতি বলা আছে, যদি কোনো কাস্টমারদের কাছে বিক্রিত বাতিল মোবাইল হ্যান্ডসেটটি রিসাইক্লিং করতে হয়, তাহলে সেটি যেনো তাদের কাস্টামার কেয়ারের মাধ্যমে করা হয়। কোন কাস্টমার যদি পুরানো অচল বা বাতিল মোবাইল হ্যান্ডসেট দিয়ে নতুন মোবাইল নিতে চায়, তখন তাকে ইনসেন্টিভের মাধ্যমে যেনো নতুন মোবাইল হ্যান্ডসেট দেয়া হয়।

এ সকল নিয়ম-নীতি বাংলাদেশের কোন মোবাইল উৎপাদনকারী কোম্পানি  মেনে চলে না। এমনকি এ সকল নিয়ম-নীতি অনেক কোম্পানি জানেও না। আবার নিয়ন্ত্রক কমিশন বিটিআরসির পক্ষ থেকেও এসব কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে কোন পরিদর্শন বা মনিটরিং করে না।  ফলে সাধারণ গ্রাহকরা ই-বর্জ্যগুলি অবাধে ফেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি দোকানদাররা সেগুলি কিনে নিয়ে পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ই-বর্জ্যগুলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ  পৃথক করছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট অংশ রেখে বাকি বর্জ্যগুলো রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। ওই ই-বর্জ্যগুলো ঠিক পদ্ধতিতে রিসাইক্লিংয়ের কাজও ব্যাহত হচ্ছে। এমন কি ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সেগুলি দেশের বাইরে বিক্রিও করা হচ্ছে।  অপরিকল্পিতভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে যাচ্ছে।

ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলি টেলিকম ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা অনুসারে মোবাইল হ্যান্ডসেটের ই-বর্জ্য সংগ্রহের কাজ সঠিকভাবে করছে কি-না এসব কার্যক্রম মনিটরিংয়ের বিষয়ে  বিটিআরসির কমিশনার  বলেন, এবিষয়ে নির্দেশনা তো আছেই। সে অনুসারে যে ১৬টি  ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির ফ্যাক্টরি আছে, সেগুলি আমরা মাঝে মাঝে পরিদর্শন করি। 

এ প্রসঙ্গে গ্রাহক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশকে বলেন, বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা থাকলেও ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলি সেটি অনুসারে  মোবাইল ফোন ই-বর্জ্য সংগ্রহ করছে না। নীতিমালা থাকলেও সেটির বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সেই সাথে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) গাইডলাইন ও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে উৎপাদিত ইলেকট্রিক/ইলেকট্রনিক্স বা   মোবাইল হ্যান্ডসেট ই-বর্জ্য গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। যেমন, প্রতিটি হ্যান্ডসেট শোরুমে বিক্রি করার সময় বিক্রয় প্রতিনিধি গ্রাহককে বলেই দিবে যে, আপনার হ্যান্ডসেট যদি নষ্ট হয়ে যায় বা ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যায়, তাহলে সেটি বাসায় ফেলে না রেখে আমাদের শোরুমে এসে জমা দেবেন। এর বিনিময়ে আপনি নির্দিষ্ট অংকের অর্থ বা নতুন হ্যান্ডসেট কেনার সময় কিছু সুবিধা পাবেন।

সংগঠনটির সভাপতি বলেন, এ সকল নিয়ম-নীতি বাংলাদেশের কোন মোবাইল উৎপাদনকারী কোম্পানি  মেনে চলে না। এমনকি এ সকল নিয়ম-নীতি অনেক কোম্পানি জানেও না। আবার নিয়ন্ত্রক কমিশন বিটিআরসির পক্ষ থেকেও এসব কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে কোন পরিদর্শন বা মনিটরিং করে না। ফলে সাধারণ গ্রাহকরা ই-বর্জ্যগুলি অবাধে ফেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি দোকানদাররা সেগুলি কিনে নিয়ে পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নিয়ে ই-বর্জ্যগুলির গুরুত্বপূর্ণ অংশ  পৃথক করছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট অংশ রেখে বাকি বর্জ্যগুলি রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। ওই ই-বর্জ্যগুলি সঠিক পদ্ধতিতে রিসাইক্লিংয়ের কাজও ব্যাহত হচ্ছে। এমন কি ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সেগুলি দেশের বাইরে বিক্রিও করা হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে যাচ্ছে।

সংবাদটি পঠিত হয়েছে: ২৩২ বার

বিশেষ প্রতিবেদন সম্পর্কিত নিউজ