ছবি: টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা বাদ দিলাম। তাদের প্রযুক্তিপণ্যের বিষয়ে ধারণা কম। কিন্তু যারা শিক্ষিত, স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল পদে আছেন, এমন অনেক শিক্ষিত নাগরিকও ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও রিসাইক্লিং বিষয়টার সাথে তেমনভাবে পরিচিত না। এমনকি অনেকে জানেনই না যে যেকোন ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা প্রোডাক্ট ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর এটা ই-বর্জ্য পদার্থে পরিণত হয়ে যায়।
বাংলাদেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৬ কোটি কেজিই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়। প্রতি কেজির দাম যদি ১ ডলার সমান মূল্য হয়, তাহলে ১৬ কোটি হাজার ডলার অর্থাৎ এখানে ১৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ই-বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এটাকে আমরা যদি নিজ থেকে থেকে ম্যানেজ করতে পারি, তাহলে বছরে ৮ হাজার কোটি টাকার ই-বর্জ্য আমরা ম্যানেজ করতে পারবো। অন্যদিকে, এই ই-বর্জ্য ম্যানেজ করার জন্য চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আবার ই-বর্জ্যে সোনা, রুপা, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য দামি ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে ‘আরবান মাইন’ বলা হয়। এর মধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে। শুধু বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে এই ই-বর্জ্য পরিণত হতে পারে দেশের একটি মূল্যবান সম্পদে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ই-বর্জ্য নয়। এটা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এ ই-বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়োজন আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
সম্প্রতি টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের সাথে একান্ত আলাপে কথাগুলো বলেছেন এনএইচ এন্টারপ্রাইজ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হায়দার। আলাপে উঠে আসে দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য আলাপের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: আপনার দৃষ্টিতে বর্তমানে দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সার্বিক পরিস্থিতি কেমন?
নাজমুল হায়দার: যেকোনো দেশের জন্যই একটা সুষ্ঠু ও আধুনিক মানসম্মত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা রিসাইক্লিং সিস্টেম গড়ে তোলা অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য অস্ট্রেলিয়াতে বেশ কিছুদিন থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে দেখেছি মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার করা ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য, ডিভাইস, আইসিটি, টেলিকম ও মেডিকেল সেক্টরের ই-বর্জ্যগুলোর ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম কত উন্নত। অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মানসম্পন্ন অবকাঠামো রয়েছে। সেসাথে রয়েছে উন্নত ও প্রযুক্তিসম্পন্ন ল্যাব, ফ্যাক্টরিও স্কিলড রিসোর্স। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা বা গাইডলাইনও। সেটাকে সবাই সম্মান করে। গাইডলাইন মেনে বিজ্ঞানসম্মত উপায়েই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে।
আমাদের দেশে সরকার ইতোমধ্যেই ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে মহাকর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সব সেক্টরকে স্মার্ট করতে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এত কিছু করলেও আমাদের দেশে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত সিস্টেম বা মেথড, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো কোনটাই গড়ে উঠেনি। উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইন্ডাস্ট্রিটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমানে দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে যা করা হচ্ছে, সেগুলো করা হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক ও অপরিকল্পিতভাবে। বলতে গেলে, সম্পূর্ণ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ই-বর্জ্য যে যার মতো ব্যবস্থাপনা করছে। সরকারি, বেসরকারি, একাডেমিয়া ও স্টেইক হোল্ডার সবাই একসাথে মিলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটা সিস্টেম ও অবকাঠামো গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উপযুক্ত সিস্টেম ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে উঠেনি কেনো?
নাজমুল হায়দার: আমাদের দেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ বসবাস করছে। বিপুল সংখ্যক মানুষের এই দেশে ১৮.৫১ কোটি মুঠোফোন গ্রাহক রয়েছে। এসব মানুষের বেশির ভাগ আবার স্মার্ট ওয়াচ, ওয়্যারলেজ হেডফোন, চার্জার, পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এগুলো যে ই-বর্জ্য পদার্থে পরিণত হচ্ছে এবং এসব বর্জ্যেরও যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা ও সচেতনতা খুবই কম। একই ভাবে মানুষের প্রতিদিনকার জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার করা ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য, ডিভাইস, আইসিটি, টেলিকম ও মেডিকেল সেক্টরেরই-বর্জ্যগুলো যে সুষ্ঠুভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ব্যবস্থাপনা করতে হয়, এসব ই-বর্জ্যের যে ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা ও সচেতনতা অনেক কম। সরকারিভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়নে কার্যকর নেই কোনো উদ্যোগ।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা বাদ দিলাম। তাদের প্রযুক্তিপণ্যের বিষয়ে ধারণা কম। কিন্তু যারা শিক্ষিত, স্কুল-কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল পদে আছেন, এমন অনেক শিক্ষিত নাগরিকও ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও রিসাইক্লিং বিষয়টার সাথে তেমনভাবে পরিচিত না। এমনকি অনেকে জানেনই না যে যেকোন ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা প্রোডাক্ট ব্যবহারের একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর এটা ই-বর্জ্য পদার্থে পরিণত হয়ে যায়। আমি মনে করি, আমাদের দেশে ‘ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং’ শব্দটার সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় কম থাকা এবং দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে জ্ঞান এবং এ সেক্টরের উপর পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ও গবেষণা না থাকায় সেক্টরটি আজ অবহেলিত। সেসাথে অবহেলিত সেক্টরটি নিয়ে মিডিয়াতেও সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়নি। ই-বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবেশের উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। দেশে যথাযথ পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেম বা মেথড না থাকায় পানি, বায়ু এবং মাটি দূষিত হচ্ছে। বাড়াচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং বিনষ্ট করছে জমির উর্বরতা। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এই বিষয়গুলো সেভাবে দেশের দায়িত্বশীলদের কাছে তুলে ধরা হয়নি।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: এখন আমাদের করণীয় কী?
নাজমুল হায়দার: অত্যন্ত জনবহুল এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য যে একটা বড় ধরনের জাতীয় সমস্যা হয়ে উঠছে, মানুষের জীবনে যা নিয়ে আসতে পারে বড় ধরনের ক্ষতি, বিষয়টা সারাদেশের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। আর এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করতে হবে। পরিবেশ অধিদফতর থেকে এখন পর্যন্ত এনএইচ এন্টারপ্রাইজসহ বাংলাদেশের ১০টি কোম্পানি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লাইসেন্স পেয়েছে। এখান থেকে মাত্র কয়েকটি কোম্পানি সক্রিয়ভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করছে। বাকিগুলো কাজ করছে কি-না আমার জানা নেই। অন্যদিকে দেশীয় কোর্পোরেট ও ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো এখনও ই-বর্জ্য যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রিসাইক্লিং করা যে দেশের জন্য একটা জাতীয় ইস্যু, এটার গুরুত্ব তারা তেমনভাবে উপলব্ধি করে উঠতে পারেনি। এর কারণ তাদের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে জ্ঞান ও ধারণা কম।তাই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না। তারা চিন্তা করে আমার কোম্পানির প্রোডাক্টটা একটা ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কোম্পানিকে দিলে আমরা কত টাকা পাবো? এর থেকে একটা ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে দিলে এর চেয়ে বেশি টাকা পাবো। তাই অনেক সময় আমাদের দেশীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি টাকার জন্য তাদেরই-বর্জ্য কাঁচামাল ওই ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে দেয়।
অন্যদিকে এর বিপরীত চিত্র লক্ষ্য করা যায় আন্তর্জাতিক জায়ান্টগুলি কোম্পানিগুলোর দিকে। জিপি, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল, এরিকসন, সিমেন্স, নকিয়া, স্যামসাং, হুয়াওয়ের মতো আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো তারা তাদের ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করা নিয়ে সচেতন। এসব কোম্পানিগুলো আমাদের মাধ্যমে তাদের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে থাকে। কিন্তু দেশীয় কোম্পানিগুলো ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করা নিয়ে তেমন বেশি সচেতন না। যেসব কোম্পানি সচেতন তারা সবসময় টাকার পিছনে ঘুরে। তারা বুঝতে চায় না যে, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশের জন্য একটা বড় জাতীয় ইস্যু। আরও দুঃখজনক বিষয় হলো, বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে যে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, সেটি পড়ে আছে শুধু কাগজে-কলমে। বাস্তবে সেটির প্রয়োগ খুবই কম। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কিছু জায়ান্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রনিক ও টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির কোম্পানিগুলো ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে। বাকিরা সঠিক নিয়মে করছে না।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারি, বেসরকারি, একাডেমিয়া ও স্টেইক হোল্ডার সবাই একসাথে মিলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে ১০টি কোম্পানি লাইসেন্স পেয়েছে সেগুলোর কাজ করার মতো যোগ্যতা, দক্ষতা ও সামর্থ্য আছে কি-না, সেগুলো বিটিআরসির পক্ষ থেকে তদন্ত করতে হবে। যারা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাজ করার মতো যোগ্য, তাদেরকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করাতে হবে। যারা কাজ করতে পারবে না তাদের কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করে, যাদের যোগ্যতা আছে তাদের সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা দিয়ে সহজে কাজ পেতে সুযোগ করে দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ই-বর্জ্যগুলো ভেন্ডরের কাছে আনার প্রক্রিয়া এবং আনার পর ভেন্ডরকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং করার প্রক্রিয়াকে সহজীকরণ করতে হবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: বিভিন্ন সময় শোনা যায় আমাদের দেশের ই-বর্জ্য নাকি বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, বিষয়টা কী গুঞ্জন, না আসলেই পাচার করা হচ্ছে?
নাজমুল হায়দার: দেখুন বিষয়টা এখন আর গুঞ্জন না। ঘটনাটা আসলেই ঘটছে। এসব ঘটছে আমাদের সবার চোখের সামনেই। কিন্তু কেউ বিষয়টা বুঝছেন, আবার কেউ বুঝতেছেন না। কেননা, সবাই তো জানেন না এসব পুরোনো ও অচল মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মনিটর, ডেস্কটপ নিয়ে তারা কি করছেন। এবিষয়ে সাধারণ মানুষের জ্ঞানের অভাব এবং সচেতন না হওয়াতে পার্শ্ববর্তী দেশের এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী আমাদের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এসব স্ক্র্যাপ বা ভাঙ্গারি পণ্য হিসেবে সংগ্রহ করে কৌশলে বিদেশে পাচার করছে। আর ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা পুরোনো ও অচল আইসিটি, টেলিকম ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স ইলেকট্রনিক পণ্য সংগ্রহে ছোট ছোট ভাঙ্গারি দোকানদারদের ব্যবহার করছে। আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, বর্তমানে রাস্তার অলিত-গলিতে ভ্যানে করে ভাঙ্গারি দোকানদার ছোট মাইক বাজিয়ে এসব নষ্ট ইলেকট্রনিক পণ্য সংগ্রহ করছেন। তারা সংগ্রহকৃত কাঁচামাল ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের কাছে জমা দেয়। অন্যদিকে, বিভিন্নভাবে চুরি হওয়া টেলিকম যন্ত্রপাতি ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের কাছে আসে। সেগুলো আবার হাত বদল হয়ে যায় ট্রেডারদের কাছে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে তারা আবার গুরুত্বপূর্ণ কম্পনেন্টগুলো বিক্রি করেন পার্শ্ববর্তী দেশের ওই অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে। তারা পাচার করে দেন পার্শ্ববর্তী দেশে।
ই-বর্জ্য পাচার রোধে আরেকটি টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলামে ই-বর্জ্য বিষয়টাকে যোগ করে ধারাবাহিকভাবে হাইস্কুল ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেও এটার ভাল-মন্দ, সুফল ও কুফল বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। তাহলে যে শিশু স্কুল থেকে বিষয়টা শিখে বের হবে, সে সারা জীবন সচেতন হবে এবং সে অনুসারে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-বর্জ্যর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণায় জোর দিতে হবে। বেশি বেশি ট্রেনিং, সেমিনার, আলোচনা সভা, কুইজ প্রতিযোগিতা এবং এই সেক্টরের সমস্যাগুলো নিয়ে সমাধানের জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার সল্যুশন তৈরি বা উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে এ সম্পর্কে সম্পৃক্ত করতে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করলে একটা সময়ে গিয়ে দেশও একটা সিস্টেমের মধ্যে চলে আসবে।
তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কোন বিজ্ঞানসম্মত মেশিন ব্যবহার করে না। ম্যানুয়েল প্রক্রিয়ায় তারা এসব কাজ করে থাকে। প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান বা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দক্ষ ব্যক্তি দিয়ে কাজগুলো পরিচালনা না করায় ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল থেকে ম্যানুয়েল প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ কম্পনেন্টগুলো বের করে নিয়ে বাকি অংশগুলো ফেলে দেয়। ফলে ওই অংশগুলোতে থাকা ক্ষতিকর সীসা, এসিড, পারদ, সিলভার, তামা মাটি ও পানিতে মিশে দুটিই দূষিত করছে। ঢাকার পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে অবৈধভাবে এসব কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। খাত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল থেকে এসব কার্যক্রম কখনো মনিটরিং করা হয় না। অন্যদিকে, আমাদের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের দেয়া গুরুত্বপূর্ণ কম্পনেন্ট ওই অসাধু বিদেশি কোম্পানিগুলো কৌশলে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এভাবে আমাদের দেশের ই-বর্জ্য বাইরে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে, অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিতভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করায় হুমকীর মুখে পড়ছে আমাদের মাটি, পানি ও বায়ু।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: এ প্রসঙ্গে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা কী বলে?
নাজমুল হায়দার: ঝুঁকিপূর্ণ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী ই-বর্জ্য সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, সবশেষ স্তরের ভোক্তা এবং এসব পণ্যের মেরামতকারীদের নিজস্ব খরচে ই-বর্জ্য অনুমোদিত হ্যান্ডলার (রিসাইক্লিং) প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দিতে হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, এরপর অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে এসব পণ্য খুলে বা পৃথক করে পরিবেশ-সম্মত উপায়ে রিসাইকেল করবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: দেশের ই-বর্জ্য সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নীতিমালা মানছে না কেনো? আপনার অভিজ্ঞতা কি বলে?
নাজমুল হায়দার: আমার ১৩ বছরের অভিজ্ঞতায় দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইন্ডাস্ট্রির কার্যক্রম থেকে বলবো বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১ এর শিথিল প্রয়োগই এর জন্য দায়ী। দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা থাকলেও সেটা আছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে সেভাবে এই নীতিমালা তেমন কোন প্রয়োগ নেই। এসব নীতিমালা মানছে না দেশীয় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলো। এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে যে একটা টিম দরকার সেটিও করা হচ্ছে না। সেসাথে ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিগুলো এই নীতিমালা যথাযথভাবে পালন করছে কি-না সেটিও সঠিক মনিটরিং ও তদারকি করা হচ্ছে না। একদিকে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অন্যদিকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সিস্টেম ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কতিপয় মালিকরা। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নিলে মালিকরা সঠিক নিয়মে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটা করতে বাধ্য থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
উন্নত দেশে ই-বর্জ্য সংরক্ষণের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনের প্রচলন থাকলেও আমাদের দেশে সেটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। এছাড়া, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে এসব পণ্য সংগ্রহের জন্য কোন সিস্টেম, চ্যানেল বা পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়নি। ফলে অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ। স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের এই সময়ে সব সেক্টরকে যখন স্মার্ট করে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তখন ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সেক্টরটাকেও স্মার্ট করতে হবে। দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন একটা অবকাঠামো গড়ে তোলা সময়ের দাবি।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে বিদেশে ই-বর্জ্য পাচার রোধ করা সম্ভব বলে মনে করেন?
নাজমুল হায়দার: বিদেশে ই-বর্জ্য পাচার রোধে প্রয়োজন সরকার, একাডেমিয়া, স্টেইক হোল্ডার ও সাধারণ জনগণের আন্তরিক সদ্বিচ্ছা। সেসাথে সরকারের পক্ষ থেকে নিতে হবে প্রয়োজনীয় যথাযথ পদক্ষেপ এবং উদ্যোগ। প্রথমত, আমাদেরে দেশের ৮০% মানুষই জানে না যে, ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একটা নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে প্রতিদিনকার জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার করা ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য, ডিভাইস, আইসিটি, টেলিকম প্রোডাক্টগুলো ই-বর্জ্য পদার্থে পরিণত হয়। এসব বর্জ্যেরও যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা ও সচেতনতা খুবই কম। এর জন্য সারাদেশের মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা তৈরি করার মাধ্যমে আমাদের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাঁচামালগুলো সংগ্রহ করা যেতে পারে। ই-বর্জ্য কোনো আবর্জনা না, এটা যে জাতীয় সম্পদ, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষকে ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে ভাঙ্গারি দোকানদারদের বিষয়টা বোঝাতে হবে। গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হলে আস্তে আস্তে তারা দেশের সম্পদ দেশেই রাখবে।
ই-বর্জ্য পাচার রোধে আরেকটি টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন, প্রাথমিক শিক্ষার কারিকুলামে ই-বর্জ্য বিষয়টাকে যোগ করে ধারাবাহিকভাবে হাইস্কুল ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমেও এটার ভাল-মন্দ, সুফল ও কুফল বিষয়গুলো নিয়ে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। তাহলে যে শিশু স্কুল থেকে বিষয়টা শিখে বের হবে, সে সারা জীবন সচেতন হবে এবং সে অনুসারে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-বর্জ্যর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে গবেষণায় জোর দিতে হবে। বেশি বেশি ট্রেনিং, সেমিনার, আলোচনা সভা, কুইজ প্রতিযোগিতা এবং এই সেক্টরের সমস্যাগুলো নিয়ে সমাধানের জন্য বিভিন্ন সফটওয়্যার সল্যুশন তৈরি বা উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে এ সম্পর্কে সম্পৃক্ত করতে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করলে একটা সময়ে গিয়ে দেশও একটা সিস্টেমের মধ্যে চলে আসবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: পরিবেশ গবেষকরা বলছেন ই-বর্জ্য আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটা কীভাবে?
নাজমুল হায়দার: এবিষয়ে পরিবেশ গবেষকদের সাথে আমিও একমত পোষণ করছি। আসলেই ই-বর্জ্য আমাদের জাতীয় সম্পদ। এটি একটি অমিত সম্ভাবনার ব্যবসা। তবে এটাকে যথাযথ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে এটাকে একটা সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ২০১৮ সালে সেন্টার ফর এনভায়রোমেন্টাল অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (সিইআরএম) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) যৌথভাবে ই-বর্জ্য তৈরির পর্যালোচনা, বাংলাদেশে এর পরিবেশগত প্রভাবও সম্পদ পুনরুদ্ধার সম্ভাবনা-শীর্ষক বেজলাইন সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ টনই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ২০৩৫ সালে নাগাদ যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ লাখ ২০হাজার টন। অর্থাৎ, বার্ষিক ২০ শতাংশের মতো উচ্চ হারে বাড়ছে ই-বর্জ্য। অন্যদিকে, সোনা, রুপা, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য দামি ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে ‘আরবান মাইন’ বলা হয়। এরমধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে ই-বর্জ্য পরিণত হবে একটি মূল্যবান সম্পদে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: এখন একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। এনএইচ এন্টারপ্রাইজের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
নাজমুল হায়দার: অস্ট্রেলিয়াতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সময় বুঝতে পেরেছিলাম ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যত অনেক সম্ভাবনাময়। এই ইন্ডাস্ট্রিতে লুকিয়ে আছে কাজ করার অফুরন্ত সুযোগ। ২০১১ সালে দেশে ফিরে এসে একটা স্বনামধন্য ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কোম্পানিতে ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেই। কাজ করি ২০১৭ সাল পর্যন্ত। দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে গিয়ে একটা সময় মনে হলো নিজেই এখন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারি। তখন শুরু করি এনএইচ এন্টারপ্রাইজের কার্যক্রম। আমাদের কোম্পানির প্রধান কাজ হলো কর্পোরেট অফিস, আইসিটি ও টেলিকম সেক্টরের ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলির ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলো বিজ্ঞানসম্মত উপায় ও যথাযত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা করা। দেশে শুধু টেলিকম সেক্টরের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোতে বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সেখানে আমরা মাত্র কিছু সংখ্যক কর্পোরেট জায়ান্ট কোম্পানির কাজ করি। আমরা পুনরুদ্ধার করা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেগুলো বিদেশে রপ্তানি করি। আমাদের বেশিরভাগ রপ্তানি হয় ইন্ডিয়া, চায়না, জাপান ও কাতারে। বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৫০ কোটি টাকা।
দেশে যথাযথ পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় দূষিত করছে পানি, বায়ু এবং মাটি। বাড়াচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং বিনষ্ট করছে জমির উর্বরতাও। ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহে সস্তা ও ক্রটিপূর্ণ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি হয়। এছাড়া, পার্শ্ববর্তী দেশে ই-বর্জ্য রপ্তানিতে তাদের যথাযথ নিবন্ধনের দরকারও হয় না। অন্যদিকে, জাপানের মতো উন্নত দেশে রপ্তানি করতে হলে, আগে সব ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে, পরিবেশগত সতর্কতা অবলম্বন করে এবং যথাযথ নিবন্ধনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিচ্ছিন্ন ও তা থেকে সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে হয়। এখন এসবের কোন বালাই নাই।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: আপনারা ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
নাজমুল হায়দার: আমরা কাজ করতে গিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে থাকি সেগুলো হলো, দেশের হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রনিক, টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা অনেকেই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে তেমনভাবে গুরুত্ব দেয় না। তাই আমাদের ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের জন্য কাঁচামাল পেতে বেগ পেতে হয়। আন্তর্জাতিক জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর কাঁচামাল পেতে সহজ হয়। আর আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো এ সমস্ত ই-বর্জ্য নিয়ে টেন্ডার করে। টেন্ডারের ওপর আমরা দরদাম করে সেগুলো কিনে নিয়ে আসি। এরপর সেগুলি নিয়ে রিসাইক্লিংয়ের কাজ করি। রিসাইক্লিং করার জন্য যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি হয়রানির সেটি হলো, সংশ্লিষ্ট দেশি বা বিদেশি কোম্পানি থেকে নিজের কোম্পানির ম্যানপাওয়ার, গাড়ি দিয়ে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ওয়্যারহাউজে রাখার পর আবার ওই পণ্যের রিসাইক্লিং কাজ করার জন্য প্রয়োজন হয় আলাদা আলাদা সার্টিফিকেশন। যেতে হয় বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদপ্তরে। একটা লটের কাঁচামাল সংগ্রহ করার পর শুধু সার্টিফিকেশনের জন্য কয়েকবার যেতে হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। কোম্পানির রেজিট্রেশন আছে। এরপরও প্রত্যেকটা লটের কাঁচামাল আনার পরে কেনো আবার সেটার জন্য সার্টিফিকেশন প্রয়োজন হয় সেটা আমি বুঝি না। এটা কাজের জন্য একটা দীর্ঘসূত্রিতা হয়ে যায়। তাই এ ভোগান্তিটা সহজীকরণ করলে আমাদের কাজ অনেক দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতো।
এছাড়াও দেশে স্কিলড রিসোর্স ও আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবের অভাব রয়েছে। দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে বড় পরসরে তেমন কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়নি। এই সেক্টর উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে দীর্ঘ মেয়াদী কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। তাই ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাই সেগুলোর সুফল কম পাচ্ছি। উদ্যোক্তা হিসেবে এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগত সাপোর্ট থাকলে আমাদের কাজ আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতো।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে এসব সমস্যা সমাধান হবে বলে মনে করেন?
নাজমুল হায়দার: ই-বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবেশের উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। দেশে যথাযথ পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় দূষিত করছে পানি, বায়ু এবং মাটি। বাড়াচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং বিনষ্ট করছে জমির উর্বরতাও। ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহে সস্তা ও ক্রটিপূর্ণ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি হয়। এছাড়া, পার্শ্ববর্তী দেশে ই-বর্জ্য রপ্তানিতে তাদের যথাযথ নিবন্ধনের দরকারও হয় না। অন্যদিকে, জাপানের মতো উন্নত দেশে রপ্তানি করতে হলে, আগে সব ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে, পরিবেশগত সতর্কতা অবলম্বন করে এবং যথাযথ নিবন্ধনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বিচ্ছিন্ন ও তা থেকে সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে হয়। এখন এসবের কোন বালাই নাই।
এ বিষয়গুলো সরকারের দায়িত্বশীলরা যদি যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি বাড়াতো, টেকসই পরিকল্পনা করে সে অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনা করতো, তাহলে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের কাজ করতে অনেক সুবিধা হতো। আমাদের সরকারি অনুদানের প্রয়োজন নাই। শুধু প্রয়োজন কাজের প্রক্রিয়াগুলোকে সহজীকরণ করা। আমরা কাজগুলো যেনো স্মুথলি করতে পারি। এখনই দেশের ই-বর্জ্য সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মহাপরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হতে গেলে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে একটা শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে এটাকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে হবে।
উজ্জ্বল এ গমেজ
অধ্যাপক ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। গবেষক ও ডিজিটাল হেলথ সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ। উদ্ভাবন...