ছবি: সংগৃহীত
বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা মানছে না দেশীয় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলি। এই বিধান বাস্তবায়ন করতে যে একটা টিমা দরকার সেটিও করা হচ্ছে না। সেসাথে ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিগুলি এই নীতিমালা যথাযথভাবে পালন করছে কি না সেটিও সঠিক মনিটরিং ও তদারকি করা হচ্ছে না। কেনো করা হচ্ছে না সেটা আমরা জানি না।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনায় তথ্যপ্রযুক্তির উপর সরকার জোর দেয়ায় দেশে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে ১৮.৫১ কোটি মুঠোফোন গ্রাহক রয়েছে। কিন্তু ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এগুলো যে ই-বর্জ্য পদার্থে পরিণত হচ্ছে এবং এসব বর্জ্যেরও যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা ও সচেতনতা খুবই কম। অত্যন্ত জনবহুল এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে উঠছে, যা সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করা উচিত। কিন্তু ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা থাকলেও বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। মানুষের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা কম। বলতে গেলে, সম্পূর্ণ অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ই-বর্জ্য যে যার মতো ব্যবস্থাপনা করছে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের সাথে একান্ত আলাপে এসব কথা বলেন জেআর রিসাইকিলিং সলিউশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হোসেন জুয়েল। আলাপে উঠে আসে দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশের পাঠকদের জন্যআলাপের চুম্বক অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা রিসাইক্লিং সিস্টেম নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাই।
এম এ হোসেন জুয়েল: দেখুন, একটা দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বা রিসাইক্লিং সিস্টেম এটা একটা অনেক বড় বিষয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক, টেলিকম ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম অনেক উন্নত। সেসব দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য মানসম্পন্ন অবকাঠামো রয়েছে। সেসাথে রয়েছে উন্নত ও প্রযুক্তিসম্পন্ন ল্যাব, ফ্যাক্টরি ও স্কিলড রিসোর্স। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করার জন্য নির্দিষ্ট গাইডলাইনও রয়েছে। সেটাকে সবাই সম্মান করে। গাইডলাইন মেনে বিজ্ঞানসম্মত উপায়েই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে।
বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা মানছে না দেশীয় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলি। এই বিধান বাস্তবায়ন করতে যে একটা টিম দরকার সেটিও করা হচ্ছে না। সেসাথে ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিগুলি এই নীতিমালা যথাযথভাবে পালন করছে কি না সেটিও সঠিক মনিটরিং ও তদারকি করা হচ্ছে না। কেনো করা হচ্ছে না সেটা আমরা জানি না।
সে দিক থেকে আমাদের দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিটা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এখানে এখনও ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ওরিসাইক্লিং করার উপযুক্ত সিস্টেম, মেথড, প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সেভাবে গড়ে উঠেনি। জেআর সলিউশন্সসহ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ১০ কোম্পানি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লাইসেন্স পেয়েছে। এখান থেকে ছয়টি কোম্পানি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করছে। বাকিগুলি সঠিকভাবে কাজ করছে না। অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলি এখনও ই-বর্জ্য যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রিসাইক্লিং করা যে দেশের জন্য একটা জাতীয় ইস্যু, এটার গুরুত্ব তারা তেমনভাবে উপলব্ধি করে না। তারা চিন্তা করে আমার প্রোডাক্টটা একটা ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং কোম্পানিকে দিলে আমরা কত টাকা পাবো। এর থেকে একটা ভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে দিলে এর চেয়ে বেশি টাকা পাবো। তাই অনেক সময় আমাদের দেশীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি বেশি টাকার জন্য তাদেরই-বর্জ্য কাঁচামাল ওইভাঙ্গারির দোকানে বিক্রি করে দেয়।
জিপি, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল, এরিকসন, সিমেন্স, নকিয়া, স্যামসাং, হুয়াওয়ের আন্তর্জাতিক জায়ান্টগুলি কোম্পানিগুলি তারা ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংসম্পর্কে সচেতন। তারা আমাদের মাধ্যমে তাদের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে থাকে। এসব কোম্পানির পক্ষ থেকে নিজেরাই আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। আমরাও তাদের কাছে যাই। কিন্তু স্থানীয় ও দেশীয় যে সমস্ত কোম্পানিগুলো রয়েছে তারা সবসময় টাকার পিছনে ঘুরে। তারা বুঝতে চায়না যে, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আমাদের দেশের জন্য যে একটা বড় ইস্যু। বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে যে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা রয়েছে সেটি আছে কাগজে-কলমে। বাস্তবে সেটির প্রয়োগ খুবই কম। গ্লোবাল ব্র্যান্ডের কিছু জায়ান্ট হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রনিক, টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির কোম্পানি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করে থাকে। বাকিরা সঠিক নিয়মে করছে না।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: কেনো করছে না? আপনার অভিজ্ঞতা কি বলে?
এম এ হোসেন জুয়েল: সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্টবাংলাদেশ বাস্তবায়নের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো এখনও অনেক শিক্ষিত নাগরিক ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং বিষয়টার সাথে তেমনভাবে পরিচিত না। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের তো এসব বিষয়ে ধারণাই নেই। দেশের হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রনিক, টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা অনেকেই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে তেমনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে বাতিল ইলেকট্রনিক যন্ত্র থেকে সৃষ্ট ই-বর্জ্য। বিটিআরসি ও পরিবেশ অধিদফতরের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নীতিমালা মানছে না দেশীয় ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলি। এই বিধান বাস্তবায়ন করতে যে একটা টিম দরকার সেটিও করা হচ্ছে না। সেসাথে ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিগুলি এই নীতিমালা যথাযথভাবে পালন করছে কি না সেটিও সঠিক মনিটরিং ও তদারকি করা হচ্ছে না। কেনো করা হচ্ছে না সেটা আমরা জানি না। একদিকে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, অন্যদিকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সিস্টেম ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কতিপয় মালিকরা। এখানে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযত প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে মালিকরা সঠিক নিয়মে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটা করতেবাধ্যথাকবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: জেআর রিসাইক্লিং সলিউশনস লিমিটেডের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাই।
এম এ হোসেন জুয়েল: যেহেতু উন্নত দেশের তুলনায় আমাদের দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইন্ডাস্ট্রিটা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তাই এটাকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় কারানোর কাজটা আমরা করে যাচ্ছি। ইন্ডাস্ট্রির কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষের ধারণা কম। এখানে যে লুকিয়ে আছে অনেক সম্ভাবনাময় একটা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শিল্প, এই বিষয়টা বিভিন্ন সেমিনার, আলোচনা সভা, ওয়ার্কশপের মাধ্যমে মানুষকে জানানো ও সচেতন করার চেষ্টা করছি। ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্স। আমরা পুনরুদ্ধার করা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সেগুলি বিদেশে রপ্তানি করি। আমাদের বেশিরভাগ রপ্তানিই হয় জাপান ও কাতারে। বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
দুঃখজনক বিষয় হলো এখনও অনেক শিক্ষিত নাগরিক ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং বিষয়টার সাথে তেমনভাবে পরিচিত না। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের তো এসব বিষয়ে ধারণাই নেই। দেশের হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ইলেকট্রনিক, টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা অনেকেই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে তেমনভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আমাদের কোম্পানির প্রধান কাজ হলো টেলিকম সেক্টরের মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলির ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে সেগুলি যথাযত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলি ব্যবস্থাপনা করা। টেলিকম সেক্টরের কর্পোরেট লেভেলে যে পরিমাণ ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, সেখানে আমরা মাত্র কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের কাজ করি। আমরা যেসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকি সেগুলি হলো, জিপি, বাংলালিংক, রবি, এয়ারটেল, এরিকসন, সিমেন্স, নকিয়া, স্যামসাং, হুয়াওয়ে এসব বড় বড় কর্পোরেট জায়ান্ট কোম্পানির কাজ থেকে ই-বর্জ্য কাঁচামাল সংগ্রহ করে থাকি।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: আপনারা ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং করতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন?
এম এ হোসেন জুয়েল: আমাদের কাজই কাঁচামাল ই-বর্জ্য থেকে রিসাইক্লিংয়ের কাজ করা।অনেক সময় আমাদের এই কাঁচামাল পেতে বেগ পেতে হয়। যেমন গ্লোবাল জায়ান্ট কোম্পানিগুলো আমাদের খুঁজে খুঁজে কাঁচামাল দিয়ে যায়। আমাদের গাড়ি পাঠাতে হয় না। নিজস্ব গাড়ি দিয়ে আমাদের ওয়্যারহাউজে দিয়ে যায়। তাদের কথা হলো, এই যে আমাদের ই-বর্জ্য এগুলোকে রিসাইক্লিং করেন। পারলে আমাদের কিছু দিয়েন। আর না পারলে দিয়েন না। তবুও এদেরকে যথাযথভাবে রিসাইক্লিং করেন। অন্যদিকে আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো এ সমস্ত ই-বর্জ্য নিয়ে টেন্ডার করে। টেন্ডারের ওপর আমরা দরদাম করে সেগুলো কিনে নিয়ে আসি। এরপর সেগুলি নিয়ে রিসাইক্লিংয়ের কাজ করি।
এছাড়াও আমরা যেসব চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে থাকি সেগুলি হলো, স্কিলড রিসোর্স ও আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবের অভাব। দেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এ পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে বড় পরসরে তেমন কোন গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়নি। এই সেক্টর উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোক্তাদের কোন প্রণোদনা দেয়া হয়নি। দীর্ঘ মেয়াদী কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। তাই ব্যক্তি উদ্যোগে যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাই সেগুলির সুফল কম পাচ্ছি।উদ্যোক্তা হিসেবে এটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সাপোর্ট থাকলে আমাদের কাজ আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতো।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: আমাদের দেশের ই-বর্জ্য বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
এম এ হোসেন জুয়েল: বিষয়টা গুঞ্জন না। আসলেই ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এসব ঘটছে আমাদের চোখের সামনেই। কিন্তু কেউ বিষয়টা বুঝছেন, আবার কেউ বুঝতেছেন না। কেননা সবাই তো জানেন না এসব পুরোনো ও অচল মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, মনিটর, ডেস্কটপ দিয়ে কি করা হয়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে বর্তমানে রাস্তার অলিত-গলিতে ভ্যানে করে ভাঙ্গারি দোকানদার ছোট মাইক বাজিয়ে এসব নষ্ট ইলেকট্রনিকপণ্য সংগ্রহ করছে। এই বাজারের সবচেয়ে বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা। তারা সরাসরি চীনে স্ক্র্যাপ বা ভাঙ্গারি হিসেবে রপ্তানি করে।
চাইনিজ ও ইন্ডিয়ান কিছু সংখ্যক ব্যক্তি তাদেরকে এগুলো সংগ্রহ করার জন্য ফাইনান্স করছে। তাদেরকে ৫০০০ টাকা দিয়ে বলে দেয়া হয়ে থাকে, তুমি আমাকে এই ধরনের কাঁচামালগুলি সংগ্রহ করে দিবা। সেগুলির উপর একটা দাম নির্ধারণ করে দেয়া হয়। যতবেশি সংগ্রহ করবে নির্দিষ্ট মূল্যে ওই টাকা থেকে মাইনাস করা হবে। পরে সংগ্রহকৃত কাঁচামাল মেশিনে প্রক্রিয়া করে গুরুত্বপূর্ণ কম্পনেন্টগুলো নিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমাদের ভাঙ্গারি দোকানগুলোর মাধ্যমে এ কার্যক্রমটা পরিচালিত হচ্ছে। তাদের মাধ্যমে আমাদের দেশের ই-বর্জ্য বাইরে চলে যাচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১ এর শিথিল প্রয়োগইএজন্যদায়ী।
২০৩৫ সালে নাগাদ যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন। অর্থাৎ, বার্ষিক ২০ শতাংশের মতো উচ্চ হারে বাড়ছে ই-বর্জ্য। অন্যদিকে, সোনা, রুপা, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য দামি ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে ‘আরবান মাইন’ বলা হয়। এরমধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে। পরিবেশ-সম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে ই-বর্জ্য পরিণত হবে একটি মূল্যবান সম্পদে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় এ প্রসঙ্গে কি রয়েছে?
এম এ হোসেন জুয়েল: ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় ই-বর্জ্য সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, সবশেষ স্তরের ভোক্তা এবং এসব পণ্যের মেরামতকারীদের নিজস্ব খরচে ই-বর্জ্য অনুমোদিত হ্যান্ডলার (রিসাইক্লিং) প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, এরপর অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে এসব পণ্য খুলে বা পৃথক করে পরিবেশ-সম্মত উপায়ে রিসাইকেল করবে। তবে এই নীতির প্রয়োগ নেই সেভাবে। ই-বর্জ্যের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনের প্রচলনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এছাড়া, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে এটি সংগ্রহের চ্যানেলও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং একইসাথে অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া অমিত সম্ভাবনার ই-বর্জ্যের ব্যবসা।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: বিদেশে ই-বর্জ্য পাচার রোধে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
এম এ হোসেন জুয়েল: গণসচেতনতা তৈরি করার মাধ্যমে আমাদের এই কাঁচামালগুলি সংগ্রহ করে চীন বা ইন্ডিয়ায় না পাঠিয়ে এগুলো আমাদের দেশে রাখা সম্ভব। ই-বর্জ্য কোনো আবর্জনা না, এটা যে জাতীয় সম্পদ, সে বিষয়ে সাধারণ মানুষকে ধারণা দিতে হবে। বিশেষ করে ভাঙারি দোকানদারদের বিষয়টা বোঝাতে হবে। সেসাথে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। চাইনিজ ও ইন্ডিয়ানরা ভাঙারি দোকানদারদের হাতে যে পরিমাণ টাকা দিয়েছে এর বদলে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ভাল কোন সুযোগ-সুবিধার অফারসহ টাকাও দিতে হবে। গুরুত্ব বোঝাতে সক্ষম হলে আস্তে আস্তে তারা দেশের সম্পদ দেশেই রাখবে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: বলেছেন ই-বর্জ্য আমাদের জাতীয় সম্পদ. . .
এম এ হোসেন জুয়েল: দেখুন, একটি স্মার্টফোন সম্পূর্ণ খুলে প্রায় ২০০ টাকা মূল্যের ২৬ ধরনের আইটেম পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে ৫০% মানুষ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে। তাহলে সাড়ে আট কোটি মানুষ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে। এই মানুষগুলো যদি বছরে এক কেজি করেও ই-বর্জ্য তৈরি করে, তাহলে দেশে সাড়ে আট কোটি কেজিই-বর্জ্য জমা হয়। আসলে গড়ে আরও বেশি হয়।
২০১৮ সালে সেন্টার ফর এনভায়রোমেন্টাল আন্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (সিইআরএম) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) যৌথভাবে-ই-বর্জ্য তৈরির পর্যালোচনা, বাংলাদেশে এর পরিবেশগত প্রভাব ও সম্পদ পুনরুদ্ধার সম্ভাবনা-শীর্ষক বেজলাইন সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ২০৩৫ সালে নাগাদ যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন। অর্থাৎ, বার্ষিক ২০ শতাংশের মতো উচ্চ হারে বাড়ছে ই-বর্জ্য। অন্যদিকে, সোনা, রুপা, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য দামি ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে ‘আরবান মাইন’ বলা হয়। এরমধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে। পরিবেশ-সম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে ই-বর্জ্য পরিণত হবে একটি মূল্যবান সম্পদে।
২০১৮ সালের বেজলাইন সমীক্ষাটি জানায়, ১ টন হ্যান্ডসেটে থাকে সাড়ে তিন কেজি রুপা, ৩৪০ গ্রাম সোনা, ১৪০ গ্রাম প্যালাডিয়াম এবং ১৩০ কেজি তামা।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে হার্বাট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৬ কোটি কেজি ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়। প্রতি কেজির দাম যদি ১ ডলার সমান মূল্যহয়, তাহলে ১৬ কোটি হাজার ডলার অর্থাৎ এখানে ১৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ই-বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। এটাকে আমরা যদি নিজ থেকে থেকে ম্যানেজ করতে পারি, তাহলে বছরে ৮ হাজার কোটি টাকার ই-বর্জ্যআমরা ম্যানেজ করতে পারবো। অন্যদিকে, এখানে চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। কাজেই এটা ই-বর্জ্য নয়। এটা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এ ই-বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য আমাদের সকলের সম্মিলিত চেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে।
টেকওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ: পরিবেশ গবেষকদের ভাষ্যমতে বর্তমানে ই-বর্জ্যের কার্বণ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু কীভাবে?
এম এ হোসেন জুয়েল: ই-বর্জ্য মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি পরিবেশের উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। দেশে যথাযথ পদ্ধতিতে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় দূষিত করছে পানি, বায়ু এবং মাটি। বাড়াচ্ছে পরিবেশের তাপমাত্রা এবং বিনষ্ট করছে জমির উর্বরতাও। ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহে সস্তা ও ক্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি হয়। এছাড়া, চীনে ই-বর্জ্য রপ্তানিতে তাদের যথাযথ নিবন্ধনের দরকারও হয় না। অন্যদিকে, জাপানের মতো উন্নত দেশে রপ্তানি করতে হলে, আগে সব ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে, পরিবেশগত সতর্কতা অবলম্বন করে এবং যথাযথ নিবন্ধনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম বিচ্ছিন্ন ও তা থেকে সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে হয়।
২০১৮ সালের সিইআরএম-বুয়েটের সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ই-বর্জ্যে থাকে সীসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি)-র মতো বিষাক্ত ও ক্ষতিকর উপাদান। আরও থাকে পলিব্রোমিনেটেড ডিফাইনিল ইথার এবং পলিব্রোমিনেটেড বাইফেনিলের মতো অর্গানিক উপাদান, যা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশ দূষণের কারণ হয়। এখনই দেশের ই-বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মহাপরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত হতে গেলে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে একটা শিল্প হিসেবে ঘোষণা করে এটাকে শিল্পে রূপান্তরিত করতে হবে।
উজ্জ্বল এ গমেজ
অধ্যাপক ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন। গবেষক ও ডিজিটাল হেলথ সিস্টেমের একজন বিশেষজ্ঞ। উদ্ভাবন...