মঙ্গলবার

ঢাকা, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

সর্বশেষ


খবর

লেবাননে পেজারের পর

এবার ওয়াকিটকি-ল্যাপটপ বিস্ফোরণ, বাদ যাচ্ছে না মুঠোফোনও

প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, দুপুর ৩:৩০

টেকওয়ার্ল্ড প্রতিবেদক

Card image

ছবি: সংগৃহীত

গত মঙ্গলবার হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহার করা পেজার বিস্ফোরণে ১২ জন নিহত ও প্রায় ৩ হাজার লোক আহত হন। পেজারগুলোতে আগে থেকেই স্বল্প পরিমাণে হলেও শক্তিশালী বিস্ফোরক ভরা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লেবাননজুড়ে হাজারো পেজার (তারবিহীন যোগাযোগের যন্ত্র) বিস্ফোরণের পর গতকাল বুধবার দেশটিতে আবারও একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এবার ওয়াকিটকি, ল্যাপটপ, ওয়াকিটকি রেডিও, গাড়ির বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে অন্তত ১৪ জন নিহত ও ৪৫০ জন আহত হয়েছেন।

গত মঙ্গলবার হিজবুল্লাহ সদস্যদের ব্যবহার করা পেজার বিস্ফোরণে ১২ জন নিহত ও প্রায় ৩ হাজার লোক আহত হন। পেজারগুলোতে আগে থেকেই স্বল্প পরিমাণে হলেও শক্তিশালী বিস্ফোরক ভরা ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মঙ্গলবারের মতো গতকালও বিভিন্ন স্থানে যুগপৎভাবে যন্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরিত সব ওয়াকিটকি, ল্যাপটপ, রেডিও এবং আগুন লেগে যাওয়া বিভিন্ন আবাসিক ভবনের ছবি লোকজন দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করতে থাকেন।

এমন প্রেক্ষাপটে লেবাননজুড়ে আসলে কী ঘটছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছে আল-জাজিরা।

কোথায় ঘটল নতুন বিস্ফোরণ
গতকালের বিস্ফোরণ নিয়ে তথ্য ধীরে ধীরে আসছে। তবে দুপুরের পর রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ও দক্ষিণের টায়ার শহরে বেশ কিছু বিস্ফোরণ ঘটে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা ছবিতে দেখা যায়, বিভিন্ন গাড়িতে আগুন জ্বলছে, ধোঁয়া উঠছে একটি আবাসিক ভবন থেকে। খবরে বলা হয়, ওয়াকিটকি রেডিও, মুঠোফোন, এমনকি সৌরবিদ্যুতের প্যানেল বিস্ফোরিত হচ্ছে।

আল-জাজিরার সংবাদদাতা আলী হাশেম একটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। দক্ষিণ লেবাননে এক দাফন অনুষ্ঠান চলার সময় একটি গাড়ি বিস্ফোরিত হতে দেখেন তিনি। দৃশ্যত, কোনো ড্রোন হামলায় নয়; বরং ভেতর থেকেই গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়।

আলী হাশেম বলেন, এদিন দক্ষিণ লেবানন ও বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে একের পর এক ওয়াকিটকি ও অন্যান্য যন্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটে; যেগুলো পেজার ছিল না।

পেজার কী 
পেজার বা ‘বীপার’ হলো একটি ছোট পোর্টেবল যোগাযোগের যন্ত্র, যা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সিগন্যালের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বার্তা (সাধারণত সংখ্যাসূচক বা আলফানিউমেরিক) গ্রহণ করে। মোবাইল ফোন জনপ্রিয় হওয়ার আগে পেজার ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতো। এটি ছিল যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম; বিশেষ করে চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রযুক্তিবিদ এবং ম্যানেজারদের মতো পেশাদারদের জন্য। এটি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতো, এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও।

পেজার কীভাবে কাজ করে?
পেজার ব্যবহার সহজ, কিন্তু এটি বেশ কার্যকরী। রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা পাঠানো হলে, ডিভাইসটি একটি স্বতন্ত্র বীপ দিয়ে ব্যবহারকারীকে সতর্ক করে। এই প্রম্পটটির জন্য ব্যবহারকারীকে বার্তার প্রতিক্রিয়া জানাতে কাছাকাছি থাকা কোনো পাবলিক বা ল্যান্ডলাইন ফোন খুঁজে নিতে হয়।

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পেজারেরও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। এর নতুন মডেলগুলোতে ছোট স্ক্রীন রয়েছে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা তাদের ডিভাইসে সরাসরি ছোট বার্তাগুলো দেখতে পারে। 

নব্বইয়ের দশকে, ছোট এই ডিভাইসগুলোর জায়গা দখল করে নেয় মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের নানা সুবিধা দ্রুত পেজারের চাহিদা কমিয়ে দেয় এবং ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে পেজার বা বীপার জনসাধারণের হাত থেকে অনেকটাই অদৃশ্য হয়ে যায়।

আলী হাশেম আরও বলেন, বিস্ফোরণ ঘটতে থাকায় সড়কে-সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিতে ছোটাছুটি করতে থাকে অ্যাম্বুলেন্সগুলো। সেই সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকে আরও বিস্ফোরণের খবর।    

এই সংবাদদাতা বলেন, ‘সম্ভবত আমরা বিস্ফোরণের আরেকটি ঢেউ দেখতে চলেছি। এমনিতেই গতকালের (মঙ্গলবার) ঘটনায় লেবাননের পুরো স্বাস্থ্যসেবা খাতে হিমশিম অবস্থা। এরই মধ্যে আজ (বুধবার) আবার বিস্ফোরণ।’

কোন কোন যন্ত্রে বিস্ফোরণ
বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র বিস্ফোরিত হওয়ার খবর আসছে। এর মধ্যে আছে ওয়াকিটকি, রেডিও, ল্যাপটপ, সৌরবিদ্যুতের প্যানেল, এমনকি মুঠোফোনও। কিছু গাড়ি বিস্ফোরিত হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু গাড়িগুলো নিজস্ব ত্রুটিজনিত, নাকি এর ভেতরে থাকা কোনো যন্ত্রের কারণে (ওয়াকিটকি, ল্যাপটপ, মুঠোফোন ইত্যাদি) বিস্ফোরিত হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়।

ওয়াকিটকি ও ওয়াকিটকি রেডিও কেন বিস্ফোরিত হচ্ছে
আবারও বলতে হয়, ওয়াকিটকি এবং ওয়াকিটকি রেডিও বিস্ফোরণের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। গতকালের বিস্ফোরণের সঙ্গে যদি আগের দিন পেজার বিস্ফোরণের ঘটনার মিল থাকে, তবে কিছু পর্যবেক্ষক বিস্মিত হবেন।

এই পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় এসব যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের একটা যোগসাজশ আছে। যন্ত্রগুলোতে ১ থেকে ৩ গ্রাম শক্তিশালী বিস্ফোরক ভরা হয়ে থাকতে পারে; যেমনটা ঘটেছে পেজারের ক্ষেত্রে। তবে কিছু হিজবুল্লাহ সদস্যের ধারণা, এসব বিস্ফোরণ যন্ত্রগুলোর ব্যাটারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুযায়ী, বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে এক দাফন অনুষ্ঠানে একটি বিস্ফোরণের পর সেখানে উপস্থিত লোকজন দ্রুত তাঁদের সঙ্গে থাকা ওয়াকিটকি রেডিওর ব্যাটারি খুলে ছুড়ে ফেলতে থাকেন।

যেসব যন্ত্রে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেগুলো মূলত যোগাযোগের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে সৌর প্যানেলের মতো যন্ত্রেও বিস্ফোরণ ঘটার খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্তত এমন এক ঘটনায় একটি মেয়ে আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

গত দুদিনের বিস্ফোরণের ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হিজবুল্লাহ ও লেবানন সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েল।

কিন্তু গতকাল বিস্ফোরণের ঘটনার পর নিজেদের সেনাদের প্রশংসা করে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা পর্বে রয়েছি। এখন আমাদের সাহস, সংকল্প ও উদ্যম দরকার।’

নিজেদের সেনাদের উদ্দেশে দেওয়া ওই বক্তৃতায় গ্যালান্ট ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর প্রশংসা করে বলেন, ‘(আপনাদের কাজের) ফলাফল বেশ চমৎকার।’

ইসরায়েল কেন এসব বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে
ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল স্পষ্ট নয়। কিন্তু ওই হামলা যে দেশটির সঙ্গে লেবানন ও হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর উত্তেজনা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে তুলবে, সেটি পরিষ্কার।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরেই দেশটির সঙ্গে সীমিত পর্যায়ে হিজবুল্লাহর সংঘাত চলছে। এর মধ্যেই ওই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এ ঘটনায় দুপক্ষের মধ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী গতকাল সকালে এক বক্তব্যে এ আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছেন। তিনি বলেছেন, গাজায় প্রায় বছর স্থায়ী যুদ্ধে ইসরায়েলের মোতায়েন করা সেনাসদস্য ও রসদসামগ্রী উত্তরে লেবানন সীমান্তে স্থানান্তর করবেন তাঁরা।

বৈরুত থেকে আল-জাজিরার সংবাদদাতা ইমরান খান বলেন, ‘ইসরায়েলের এ আক্রমণকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে দেখছে লেবানন। কেননা এটি সন্ত্রাসকেই আরও উসকে দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ হামলায় মানুষ আতঙ্কিত।’

নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এলিজাহ ম্যাগনিয়ার বলেন, ‘হিজবুল্লাহ ও লেবাননের সমাজের ভেতর সফলভাবে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েল।’

তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল ঠিক এটিই চায়। তারা চায়, লেবাননের মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হোক এবং এ ফাঁকে সম্ভবত তৃতীয় দফা হামলার জন্য তারা (ইসরায়েল) প্রস্তুতি নিক।’  

‘আমাদের অপেক্ষা করতে হবে ও দেখতে হবে, সামনে ইসরায়েল কী ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেননা, এই হামলাই শেষ নয়’, বলেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক এলিজাহ।

সংবাদটি পঠিত হয়েছে: ৬০ বার

এ সম্পর্কিত আরও খবর