মঙ্গলবার

ঢাকা, ১৫ অক্টোবর ২০২৪

সর্বশেষ


উদ্যোগ

দেশি প্রযুক্তিতে সেনাবাহিনীর জন্য রোবট বানালো একদল তরুণ

প্রকাশ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, দুপুর ৩:৪৯

টেকওয়ার্ল্ড প্রতিবেদক

Card image

ছবি: সংগৃহীত

রোবটিকস সোসাইটির বেশ কিছু সদস্য একত্রিত হলাম ক্যাম্পাসে। আলোচনার মাধ্যমে শুরু করলাম কাজ। শুধু ঈদের দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে পরের দিন আবার সবাই ক্যাম্পাসে ফিরি। মনে হচ্ছিল রোবটটি ঠিকঠাক বানাতে পারলে সেদিনই হবে আমাদের আসল ঈদ। সবাই মিলে একটানা ১২ দিন খেটে করে পুরো কাজটি শেষ করি।

সম্মুখযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, রোবট আর ড্রোন হয়ে উঠছে এ সময়কার যুদ্ধের মূল অস্ত্র। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বহরেও যুক্ত হয়েছে দেশীয় প্রযুক্তির একটি দূরনিয়ন্ত্রিত রোবট।

শক্রপক্ষ গাঢাকা দিয়েছে পাহাড়ি অঞ্চলে। নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে তারা চারিদিকে রেখে গেছে অজস্র বোমা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সহজে তাদের ধারেকাছেও ঘেষতে পারছে না, দুর্গম ভূখণ্ডে রেখে যাওয়া অজস্র বোমার একটিও যদি বিস্ফোরিত হয় তাহলে প্রাণের ঝুঁকি আছে সবারই। উদ্ভূত এমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে প্রায় সব দেশই।

আর এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বর্তমানে ড্রোন আর রোবটের ব্যবহার দেখা যাচ্ছে হরহামেশা। যুদ্ধক্ষেত্রে রোবট আর ড্রোন যেন এখন রেসের ঘোড়া। নিঃশব্দে গোলাবারুদ পরিবহনে কিংবা বোমা নিষ্ক্রিয় করে বদলে দিচ্ছে যুদ্ধের পরিস্থিতি। গত বছরের শীতে রুশ ও ইউক্রেনীয় দুই সামরিক বাহিনীই প্রথমবারের মতো আভিদিভকা শহরে রোবটের ব্যবহার শুরু করে।

দুই পক্ষের ড্রোন একে অন্যের ভূমিতে থাকা অন্য রোবটকে আক্রমণ করছে। রোবট বনাম রোবটের যুদ্ধে ধনী দেশগুলো এগিয়ে থাকলেও স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। আমাদের দেশেও গত বছর বিভিন্ন বাহিনীকে লুকিয়ে রাখা বোমার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছিল বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট। এসব রোবট চালানোর জন্য পুলিশ সদস্যদের দেওয়া হয়েছিল প্রশিক্ষণও।

তবে বিদেশ থেকে আনা বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবটের চেয়ে সাত থেকে দশ গুণ কম খরচে রোবট তৈরি করেছে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একদল শিক্ষার্থী। তাঁরা হলেন রুয়েট রোবটিকস সোসাইটির সভাপতি এস এম শাফায়েত জামিল (দলনেতা), সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আতিফ, মো. আল তাসদীদ উল, ইয়াশসির আরাফাত ও আরিফুল ইসলাম। তাঁরা সবাই মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। পরামর্শক হিসেবে ছিলেন যন্ত্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. রোকনুজ্জামান রানা ও মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক মো. ফিরোজ আলী।

রোবটের নাম হেডিস-এক্স-জিরোথি
‘হেডিস’ নামটি নেওয়া হয়েছে গ্রিক পুরাণের পাতাল দেবতা ‘হেডিস’-এর নাম থেকে। আর ‘জিরো-থ্রি’ নির্দেশ করে রোবটের ট্রায়াল নম্বর। বোমা শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় দুটোতেই বেশ পারদর্শী হেডিস। তিন কেজির চেয়ে কিছুটা বেশি ওজন উত্তোলন করে উঁচু-নিচু রাস্তা, মাঠ, কাদামাটিসহ যেকোনো পথ পাড়ি দিতে পারে অনায়াসেই। বর্তমানে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে এক কিলোমিটার দূর থেকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় হেডিসকে।

তবে অদূর ভবিষ্যতে আরো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে এটির নির্মাতারা। হেডিসে আছে সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা। এই ক্যামেরার সাহায্যে আসা ছবির মাধ্যমে অপারেটর বা নিয়ন্ত্রক বোমা শনাক্ত করতে পারে সহজেই। শনাক্তকরণের পর কমান্ড অনুযায়ী বোমা নিষ্ক্রিয়করণের কাজ শুরু করে দেয় রোবটিতে থাকা বিশেষ হাত। বোমা নিষ্ক্রিয়করণের সময় নির্ভর করে বোমার ধরন ও অপারেটরের দক্ষতার ওপর। তারহীন ক্যামেরা ও মাইক্রোফোন থাকার কারণে দূর থেকেই অপারেটর বা নিয়ন্ত্রককে ‘মিডিয়া কনটেন্ট’ পাঠাতে পারে এটি। হেডিসের কাছে দিন-রাত সব সমান, কারণ সেটির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে নাইট ভিশন মোড ও শক্তিশালী হেডলাইট।

১২ দিনে আস্ত এক রোবট
দলনেতা শাফায়েত জামিল বলেন, ‘নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাস থেকে আমাদের রোবটিকস সোসাইটির কাছে একটি প্রস্তাব আসে ২৮ মার্চ, বানাতে হবে বোম্ব ডিসপোজাল রোবট। তত দিনে রোজা ও ঈদের ছুটিতে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু সেনানিবাস থেকে আমাদের মাত্র ১২ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। রোবটিকস সোসাইটির বেশ কিছু সদস্য একত্রিত হলাম ক্যাম্পাসে। আলোচনার মাধ্যমে শুরু করলাম কাজ। শুধু ঈদের দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে পরের দিন আবার সবাই ক্যাম্পাসে ফিরি। মনে হচ্ছিল রোবটটি ঠিকঠাক বানাতে পারলে সেদিনই হবে আমাদের আসল ঈদ। সবাই মিলে একটানা ১২ দিন খেটে করে পুরো কাজটি শেষ করি। এই ১২ দিন আমরা নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে শুধু রোবটের পেছনেই লেগে ছিলাম। কেউ পার্টস খোঁজ করেছে, কেউ পুরনো পার্টস মেরামত করেছে, কেউ সেটিংস করেছে, কেউ প্রগ্রাম ডেভেলপ করছে-সব মিলিয়ে সবাই একযোগে বিরতিহীনভাবে কাজ করেছি। আলাদাভাবে কারোর নির্দিষ্ট কোনো রোল রাখা হয়নি, কারণ সব কাজে সবাইকে দরকার ছিল।’

১৯ এপ্রিল বিকেলে নাটোরের কাদিরাবাদ সেনানিবাসে হস্তান্তর করা হয় হেডিস-এক্স-জিরোথ্রি। রুয়েট রোবটিকস সোসাইটির শিক্ষার্থীরা ছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেদিন উপস্থিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা রোবটের বিভিন্ন ফিচার পরীক্ষা করেন এবং ভবিষ্যতে রোবটটির উন্নত সংস্করণ আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পুরোটাই দেশি প্রযুক্তি
সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরি বলে রোবটটি বানাতে খরচ হয়েছে তুলনামূলক অনেক কম এবং ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রাংশ বড় বড় মেকানিক্যাল দোকানেই পাওয়া যায়। তবে পাক্কা জহুরির মতো সেগুলো খুঁজে খুঁজে সংগ্রহ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

রুয়েট রোবটিকস সোসাইটির সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আতিফ বলেন, ‘বাংলাদেশে আধুনিক রোবটিকসে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিকস সামগ্রী তৈরি না হলেও বিভিন্ন ডিজাইনের মেকানিক্যাল ফ্রেম এবং মেকাট্রনিকস ইমপ্লিমেন্ট সম্ভব। আর সেগুলো দিয়ে খুব সহজে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বিদেশ নির্ভরতা কমানো যাবে।’

হেডিসের প্রগ্রাম ডেভেলপেও কাজ করেছে শাফায়তের দল। তাঁদের দলের সব সদস্য অনেক আগে থেকেই পুঁথিগত পড়াশোনার পাশাপাশি কারিগরি কাজে যুক্ত। বিভিন্ন প্রজেক্টে তাঁদের রোবট নিয়ে কাজ করতে হয়। সেই থেকে তাঁদের সুপ্ত বাসনা ছিল দেশের ডিফেন্স সিস্টেমের জন্য আধুনিক কিছু করা। হেডিস-এক্স-জিরোথ্রি তাঁদের সুপ্ত ইচ্ছাটা কিছুটা হলেও পূরণ করেছে।

সংবাদটি পঠিত হয়েছে: ৭২ বার

এ সম্পর্কিত আরও খবর